দীপেন্দু চৌধুরী
গত শতাব্দীর আশির দশকের উত্তর পূর্ব ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়ে এই
প্রজন্মের ভারতীয়রা কতটা জানেন? মেঘালয় রাজ্য গুয়াহাটী রাজ্যের প্রতিবেশী রাজ্য। উত্তর
পূর্ব ভারতের জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ একটা সময় ধারাবাহিক বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। যতটা না আশির দশকের আগের কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা বা উদাসীনতা ছিল তাঁর
থেকেও অনেক বেশি ছিল যোগাযোগের অপ্রতুলতা। সম্ভবত অনুন্নত পাহাড়ি উপত্যকায়
কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নের সুফল উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতি/ আদিবাসী সম্প্রদায়ের
কাছে পৌঁছয়নি এই কারণে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় আছে, নৃতত্ববিদদের মতে উত্তর পূর্ব
ভারতের জনজাতিদের অশিক্ষা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সুযোগ নিয়েছিল সমতলের
একদল উচ্চশিক্ষিত মানুষ। ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা প্রথম এই সুযোগ নেয়। তারপর উত্তর
ঔপনিবেশিক ভারতে একদল ‘বাবুশ্রেণী’ সাহেবদের চেয়ারে উপবিষ্ট হয়। পাহাড়ি মানুষের
মধ্যে শিক্ষার আলো যত পৌঁছল তাঁরা সচেতন হয়ে উঠল। নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্য,
শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা সহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগের দাবিতে এবং প্রয়োজনে তাঁরা
আন্দোলনে নামল।
শুরু হল আসু, খাসি ছাত্র আন্দোলন। বাঙালি, মাড়োয়ারি তথা বহিরাগত খেদাও
আন্দোলন এক হিংস্র রাজনীতির জন্ম দিল। পাহাড়ি উপজাতি এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে
যে সামাজিক সৌহাদ্র ছিল ভেঙে যেতে থাকল। এই নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে নির্ভর করে
গড়ে উঠল বিংশ শতাব্দীর নবীন সভ্যতা। ২৩ নভেম্বর কলকাতার অক্সফোর্ড বুক স্টোরে একটি
বই প্রকাশ হল। বইটির প্রকাশক ‘স্পিকিং টাইগার’। ইংরেজিতে লেখা বইটি শিলং গড়ে ওঠার
গল্প। আশির দশকের গল্প। বিগত শতাব্দীর
আশির দশকে উত্তর পূর্ব ভারতে রাজনৈতিক যোগাযোগও করতে হত ল্যান্ডফোন, টেলিগ্রাম
ইত্যাদির মাধ্যমে। এতটাই দুর্গম ছিল সেই সভ্যতা। বলছিলেন বইটির লেখক নীলাঞ্জন পি
চৌধুরী। লেখক বলছিলেন কলকাতার
অভিজাত বই বিপণির শ্রোতাদের সামনে। ‘বাজাজ চেতক’ স্কুটার ছিল সামাজিক অবস্থানের
পরিচিতি। লেখক নীলাঞ্জনের শৈশব, কৈশোর কেটেছে শিলং শহরে। পূর্ববঙ্গের সিলেট থেকে
তাঁর পরিবার শিলং শহরে আসে। তারপর পারিবারিক উচ্চ শিক্ষা এবং সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে
লেখক নীলাঞ্জনের মধ্যে। ইংরেজি স্কুল কলেজে পড়লেও নীলাঞ্জন মেঘালয়ের মেঘেদের পাড়ায়
পাড়ায় ঘুরেছেন। সময় কাটিয়েছেন পাহাড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাঁদের জীবন,
তাঁদের সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছেন আপন আত্মীক অনুভবে। সিলেটের ভাষা, কলকাতার আধুনিক
বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করে। পাহাড়ের সবুজ ঘেরা প্রকৃতি তাঁর হ্রদয়ে
গেঁথে রয়েছে। উচ্চ শিক্ষা লেখকের অর্জিত পাহাড়ি সারল্য কেড়ে নিতে পারেনি।
বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষিত এবং বনেদী ঘরানার লেখক নীলাঞ্জন নিজের
বক্তব্য রাখার সময় বেছে নিচ্ছিলেন ইংরেজি ভাষা, পশ্চিমবঙ্গের চলিত বাংলা ভাষা এবং
সিলেট্টি। বলতে হয় জিও নীলাঞ্জন। দীর্ঘজীবী হও। নীলাঞ্জনের নিজের লেখা থেকে টুকরো
টুকরো পাঠ তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল শিলং নামক এক গঞ্জ শহরের পাহাড়ি বস্তিতে।
আবেগ, উচ্ছাস, অভিমান ঠিকরে পড়ছিল তাঁর বক্তব্যে। কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার
যন্ত্রণা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সেই বেদনা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
বইটি সম্পর্কে প্রথম বললেন কর্পোরেট উপদেষ্টা এবং দুটি ইংরেজি বইয়ের লেখক
অভীক চন্দ। অভীকের আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়ক অভিনেতা বরুণ চন্দের
ছেলে। অভীক বইটি নিজে পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘’আঁতেল লেখকের বই নয় নীলাঞ্জনের লেখা
‘শিলং টাইমস’। হ্রদয় দিয়ে লিখেছেন লেখক। নীলাঞ্জন আমার বন্ধু হয় বলে বলছি না। বইটা
আপনারা পড়লেই বুঝতে পারবেন। দু’জন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক যুবতির নিছক প্রেমের গল্প
নয় এই উপন্যাস। সামাজিক টানাপোড়েন আছে নীলাঞ্জনের লেখা এই বইয়ে। নসটালজিয়া আছে।
ভারতের বর্তমান সময়ে এই বই ইংরেজি, বাংলা সব পাঠকের জন্য সাহায্য করবে।‘’
নীলাঞ্জন বললেন, ‘’কবির সুমনের একটা গান আছে, ‘এ শহর আমার জানে সবকিছু’।
সত্তর আশির দশকের শিলং আমার হ্রদয়ে আছে।
নব্বই দশকের আগে ভারতের মানুষ ভীষণ সরল ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। শিলং-এর
সেই সময়টা চলে গেছে। মিউজিসিয়ান, গায়ক এবং বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য
চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘ওপেন টি বাইস্কোপ’ আমাকে প্রভাবিত করেছে। এই বই লিখতে।‘’
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় সেদিন উপস্থিত ছিলেন বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের
প্যানেলিস্ট হিসেবে। তিনি বললেন, ‘’ছবিটা দেখে তুমি আমাকে একটা মেল করেছিলে। আমি
মেলের বিষয়টা বলব না। মানুষের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি।
আশি-নব্বই দশকের সময়টা এই প্রজন্মকে আমরা বোঝাতে পারব না। আমাদের কাছে টেনিদা ছিল।
ঘনাদা ছিল। গলির মধ্যে যে পৃথিবী সেই পৃথিবীও উজ্জ্বল। আমরা পালাব কোথায়? আমার
প্রথম ছবি ‘ওপেন টি বাইস্কোপ’। তাই আবেগ ছুঁয়ে গেছে ছবির পাতায় পাতায়।‘’
অনিন্দ্য আরও বলেন, ‘’বন্ধুত্বের বিষয় নিয়ে লেখা এই উপন্যাস। আমার ছবিও এই
গল্পের কাছাকাছি। সামাজিক মান্যতা পাবে না এমন একজন যুবকের গল্প আমার ছবিতে আছে।
শেষে তাঁর নিজের পাড়ার মানুষ তাঁকে মান্যতা দেয়। সে সমস্ত বিশ্বের মানুষের
সন্তান।‘’
‘শিলং টাইমস’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র দেবু। দেবুর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের
অনুভূতি, দ্বন্দ, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সামাজিক টানাপোড়েন এইসব বিষয় বইয়ের বিস্তারে
এসেছে। ইংরেজি গান সংস্কৃতির ঝাপটা আছে নীলাঞ্জনের বইয়ে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম উত্তর পূর্ব ভারতের ‘মাতৃতান্ত্রিক
সমাজ’ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। নীলাঞ্জন স্বীকার করলেন। যে বর্তমান সময়েও মেঘালয়ের
মেঘেদের পাড়ায় গেলে দেখা যাবে পরিবারের মহিলারা সংসারের প্রধান অভিভাবক। নীলঞ্জন
বললেন, ‘’আমার এই উপন্যাসে দু’টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের দু’জন যুবক যুবতির বড় হয়ে ওঠার
গল্প আছে। সেই গল্প এই বিষয়টাকেও ছুঁয়ে গেছে।‘’
গভীর বন্ধুত্ব এবং ভয়ের এক জীবন্ত উপন্যাস শিলং টাইমস। এই বইয়ের বিষয়
প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘’’About
‘’residents’’, ‘’outsiders’’ and whose right it is to live in a particular
place, this is also the moving story of friendship that transcends all
barriers, with humor and profound insight, Chowdhury marches his characters
straight into the reader’s heart.’
Hanseda Sowvendra Shekher
Onek dhonnobad Dipendu-da ato shundor akta lekhar jonno!
ReplyDelete