দীপেন্দু চৌধুরী
উৎসবের মরশুম আর কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়
থেকে ভারতে তথা আমাদের বাংলায় লোকসভা ভোটের দামামা বেজে যাবে। মধ্যপ্রদেশ,
রাজস্থান, ছত্তিসগঢ় সহ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোট নিয়ে দেশের দু’টি প্রথমসারির দল কংগ্রেস আর
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ব্যস্ত। ভারতের এই সেমিফাইনাল ভোটের আগে পশ্চিমবাংলায়
একটি ছোট্ট টোকায় প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বে পরিবর্তন এসে গেছে। কংগ্রেসের অন্দরের
খবর কংগ্রেস নিজের ‘ডিএনএ’ ফিরে পেয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর বাংলা প্রভাতি দৈনিকে আমরা
প্রথম পাতায় খবর দেখলাম ‘বাংলায় সোমেনের হাতেই কংগ্রেস’। সোমেন মিত্রকে আচমকা প্রদেশ কংগ্রেস দলের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল এমনটা
সম্ভবত নয়। লোকসভা ভোটের দামামা বেজে গেছে সেই সময় রাহুল গাঁধি এই রকম একটা
সিদ্ধান্ত নিলেন। যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল গত বছর কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ড
আরও একটা বছর অপেক্ষা করলেন। চলতি বছরের অগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে রাহুল গাঁধি
বাংলার নবনির্বাচিত নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন
বাংলায় সংগঠনকে স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দিকেই বেশি করে নজর দিতে হবে।
পার্টির লাইন ঠিক করে এক সুরে সবাইকে কথা বলতে হবে। রাহুল গত কয়েক বছরে বাংলার
কংগ্রেস নেতৃত্বের অতীত এবং বর্তমান ঘেঁটে সম্ভবত এটা বুঝতে পেরেছেন। সোমেন মিত্র হতে পারেন দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত বাংলা কংগ্রেসের অন্যতম কাণ্ডারী। পোড় খাওয়া ৭৫ বছরের নেতা এক
সময়ের দক্ষ সংগঠক বাংলার কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের পাশে থাকতে পারেন। কংগ্রেস
সূত্রে খবর ওইদিনের বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি তাহুল গাঁধি খোলসা করে বলে দিয়েছেন, ‘বাংলার
৪২টা লোকসভা আসনের একটাও কংগ্রেস না পেলেও কিছু এসে যাবে না। কিন্তু আত্মমর্যাদা
বিসর্জন দিয়ে জোট হবে না, সংগঠনের আগে কোনও কিছুর অগ্রাধিকারও থাকবে না।’
সোমেন মিত্র এবং
কংগ্রেস
সালটা ১৯৯৭। আমি একজন নকশাল নেতার
সঙ্গে তাঁর অনুরোধে হাবড়া যাচ্ছি। একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে। হাবড়ায় একটা রাজনৈতিক
অনুষ্ঠান আছে। ১৯৯৭ সালে একটি নকশালপন্থীগোষ্ঠী হিসেবে সেই নেতাটি বামফ্রন্টের
খাতায় নাম তুলতে পেরেছিলেন। হাবড়ায় বামফ্রন্টের একটি জনসভায় আমাদের যেতে হবে এটাই
জানতাম। সেই নেতার কাছে জানতে পারলাম আমাদের সামনের গাড়িতে তৎকালীন বামফ্রন্ট
সরকারের এক ডাকসাইটে মন্ত্রী আছেন। তিনি উত্তর ২৪
পরগণা জেলার সিপিএমের প্রথমসারির নেতা। তার গাড়ির সামনে পুলিশের কনভয়
আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি শুনেছিলাম হাবড়ার ওইদিনের জনসভায় সিপিএমের জনপ্রিয়
গণনেতা সুভাষ চক্রবর্তী থাকবেন। পরের ঘটনা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা হাড়ায় কোনও
একটি ক্লাবে অথবা কারও বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম। এখন ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না। তবে ওইদিনের ‘জনসভা’
কোনও এক অঞ্জাত কারণে বাতিল হয়েছিল। প্রযুক্তির উন্নতির সুযোগ তখনও ভারতে এসে
পৌছয়নি। তাই ‘মোবাইল ফোন’ কারও হাতে ছিল না। থাকলে হয়ত বামফ্রন্টের ডাকসাইটে ওই
মন্ত্রী আগে খবর পেতেন। এই পর্যন্ত আমার দেখা প্রত্যক্ষ
ঘটনা। পরেরটা যেমনটা শুনেছি।
সেদিন কোনও জনসভা ছিল না। ‘পিডিএস’ নামক একটি নতুন সংগঠন অথবা সিপিএম দল ভেঙে আরও একটি নতুন সর্বভারতীয় সমাজ গণতান্ত্রিক তথা বামপন্থী নতুন একটি দল তৈরির প্রাক প্রস্তুতির অন্যতম
একটি বৈঠক। দলটির মডেল হিসেবে সামনে ছিল ১৯৭৭ সালের ‘জনতা পার্টি’। যে দলের মঞ্চে
কংগ্রেস বিরোধী ভারতের প্রায় সব রাজনীতির নেতারা সম্মিলিত হয়েছিলেন। যদিও
কংগ্রেসনেত্রী ইন্দিরা গাঁধির নিবিড় রাজনৈতিক মেধা এবং কূটনৈতিক চালে জনতা দল খন্ড
খন্ড হয়ে যায়। সেদিনের হাবড়ার ওই বৈঠকে কোন কোন দলের কোন কোন তাবড় নেতা থাকতেন আমি
জানি না। তবে পরে শুনেছিলাম বামফ্রন্ট বিরোধী নতুন একটি গণতান্ত্রিক মঞ্চ গঠনের
প্রাক প্রক্রিয়ায় সোমেন মিত্র প্রাথমিকভাবে থাকতে রাজি হয়েছিলেন। এই নতুন মঞ্চটি
মূলত তৎকালীন যুবকংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে গড়ে উঠছিল। যে
কারণে সুভাষ চক্রবর্তী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সিপিএম দলের দৈনিক মুখপত্র
‘গণশক্তি’ পত্রিকার পালটা একটি দৈনিক ‘সোনার বাংলা’ প্রকাশ হয়ে গেছে। নতুন সমাজগণতান্ত্রিক বাপপন্থী দলটির চিন্তা ছিল সিপিএমের এক সময়ের
অত্যন্ত জনপ্রিয় যুবনেতা তথা সাংসদ সৈফুদ্দিন চৌধুরী এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয়
কমিটির সদস্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। পরে এই দু’ই নেতাকেই সিপিএম দল থেকে বহিষ্কার
করে দেওয়া হয়।
অবশেষে যদিও সিপিএম ভেঙ্গে অথবা বামফ্রন্ট ভেঙে আরও একটি নতুন সর্বভারতীয়
দল গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সিপিএমের চাণক্য নামে যাকে অভিহিত করা হয় তাঁর এক গভীর
দূরদৃষ্টির চালে এই দল গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কমরেড অনিল বিশ্বাসের বিদুরের ন্যায়
এক পাশার চালে ভারতের প্রস্তাবিত নতুন কমিউনিস্ট
পার্টির সলিল সমাধি হয়। কিন্তু সিপিএম বা কমরেড অনিল বিশ্বাস
যেটা আটকাতে পারলেন না সেটা হচ্ছে তৃণমূলকংগ্রেস নামক দল। ১৯৯৮ সালে এই দল
আত্মপ্রকাশ করল কংগ্রেস দলের উজ্জ্বল নক্ষত্র যুবনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
নেতৃত্বে। ২০০১ সালে সারা বাংলায় রব উঠেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন
সরকার গঠন হবে। সেই সরকারে সুভাষ চক্রবর্তী, সৈফুদ্দিন চৌধুরীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা
একটি মঞ্চ অংশ নেবে। শোনা কথা নিজের যোগ্যতা মত এতদিন নিজের মনের খাতায় রেখেছিলাম। কমরেড অনিল বিশ্বাসের কূটচালে
তৎকালীন সময়ে সব কিছু ভেস্তে যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে ১০ বছর
অপেক্ষা করতে হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রায় একা
‘অনাথ’-এর মত জীবন কাটাতে হয়েছে। বিভিন্ন রকমের মানসিক অত্যাচার
সহ্য করতে হয়েছে সংখ্যালঘু দলের সাংসদ হিসেবে। দিল্লিতে, কলকাতায় পদে পদে হেনস্থা
হতে হয়েছে। রাজনীতির এমনই খেলা। ২০১১ সালে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে
জোট সরকার গঠন হয় তার দু’বছর আগে অনিলদা মারা গেছেন। সিপিএম দল যোগ্য নেতৃত্বের
অভাবে ধুঁকছে। গোষ্ঠী দ্বন্দে বিদীর্ণ। সেই সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে
পেরেছিলেন পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত পাঁজা, মদন মিত্র এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
মত তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। পরেরটা ইতিহাস। ২০০৬ সালের
সিঙ্গুর ইস্যু, ২০০৭-০৮ সালে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭-৯৮ সালের অভিঞ্জতাকে কাজে লাগালেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়,
সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সুভাষ চক্রবর্তী প্রস্তাবিত ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন করলেন তৃণমূল
নেত্রী। সেই ফ্রন্টে বিক্ষুব্ধ সিপিএম, পিডিএস, বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠী, এস ইউ
সি দলের নেতাকর্মীরা এসে সামিল হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে আমি সাংবাদিক হিসেবে তৎকালীন
কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার
পূজালিতে সোমেন মিত্র একটি কর্মীসভা করছিলেন। পূজালি পুরসভা সেই সময় কংগ্রেসের দখলে ছিল। বৈঠক চলাকালীন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‘আমাকে ১০ মিনিট
সময় দিন। আমি এই মিটিং শেষ না করে কিছু বলতে পারব না।’ এতটাই সুশৃঙ্খল তিনি। তাঁর
সাংগঠনিক ক্ষমতা সুবিদিত। ২০১১ সাল থেকে
তৃণমূল আড়েবহরে বিড়াট আকাড় নিয়েছে। কংগ্রেস দলের ভাঙ্গন ২০০৯ সালেই
শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের বাংলার একজন সর্বভারতীয় নেতার প্রশ্রয়ে। এই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া চলতে থাকে গঙ্গার ভাঙ্গনের
মত। তাঁর দেওয়া অর্থ এবং প্ররোচনা
এক্ষেত্রে বড় রকমের ভূমিকা নেয়। সেই ভদ্রলোক ২০০৬ সাল থেকে প্রদেশ কংগ্রেস এবং কংগ্রেস
দলের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন। দলবদল নিয়ে রাজ্যে একটা ছড়া কাটার প্রচলন শুরু
হয়েছিল। ছড়াটা কি ছিল?
১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সোমেন মিত্র প্রদেশকংগ্রেস সভাপতি ছিলেন।
তিনি সভাপতি থাকাকালীন কংগ্রেস দলে এই ছড়া কেউ কাটতে সাহস পায়নি। ছড়াটা কি?
সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ একটা গান আছে ‘’মোরা করব এখন ডাকাতি/
রাতারাতি/ডাকাতি রাতারাতি।/ বাঘাদা বাঘাদা হীরে নিলে কত শুনি? সময় কি আছে গুণি?/
নিয়েছি যথেষ্ট।‘’ তৃণমূলকংগ্রেসে যে সব নেতারা চলে যাচ্ছেন তাঁদের আমচে চামচেদের
মুখে এই গানের কলি আমি সাংবাদিক হিসেবে শুনেছি।
সোমেন মিত্র ২০০৯ সালে লোকসভার ভোটের সময় তৃণমূল কংগ্রেসে গেলেন। তার কারণ
হয়ত রাজ্য কংগ্রেস দলে দোদুল্যমানতা এবং প্রদেশ কংগ্রেসে কোণঠাসা অবস্থা। কংগ্রেসের কেউ কেউ বলে থাকেন বাংলা তথা ভারতে ‘নাট বল্টু’ গোষ্ঠীর
একচেটিয়া আধিপত্য অনেককেই কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। পাশাপাশি
আরও একটা সম্ভবনা থেকে যায় ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকারে তৃণমূল কংগ্রেসের অংশগ্রহণ। ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন
সোমেন মিত্র। যে দূরদৃষ্টি নিয়ে
সোমেন মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসে গেলেন হল ঠিক তার উল্টো। তাঁকে উপেক্ষা করা শুরু হল।
তৃণমূল দলে সোমেনদাকে জনৈক এক নেতা কোণঠাসা করে রেখে দিয়েছিল। যত রকমের হেনস্থা করা যায় সব কিছু করা হয়েছিল। তৃণমূলের অন্দরে যেমন এই
হেনস্থার ব্যাপারে প্ররোচনা ছিল দলের বাইরেও অন্য দলের একটি গোষ্ঠীর পরোক্ষ
প্ররোচনা ছিল। ওই তৃণমূলনেতা এবং রাজ্যসভার সাংসদ দলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে
ঘোড়া কেনাবেচায় নিজেকে বড় এবং দক্ষ
ম্যানেজার হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন। ২০১১ সালের পর থেকে কংগ্রেসের ঘড়
ভেঙে বিধায়ক, গ্রামপঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, বিভিন্ন পুরসভা থেকে
সমস্ত কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধি ভাঙ্গিয়ে আনতে তিনি পটু হয়ে উঠলেন। যদিও শেষ
পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের সেই বিতর্কিত নেতাটিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যিনি
তৃণমূল দলে ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ ছিলেন সেই নেতা বিজেপিতে গিয়ে নতুন করে আর
কংগ্রেসকে ভাঙতে পারছেন না। কারণ সোমেন মিত্র নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন। কংগ্রেসের
‘ডি এন এ’ তে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন।
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের শ্রমদপ্তরের একজন আই এ এস অফিসার আমার এক বরিষ্ঠ
সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছেন ‘দীপেন্দুদাকে করুণা করা যায় না। যারা ভাবছে ওনাকে করুণা
করে সাংবাদিকতা অথবা লেখকের কাজ করাবে তাঁরা ভুল ভাবছে।‘’ আই এ এস অফিসারটি আমাকে
আশির দশক থেকে চেনেন। তিনি আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট। আমি সলজ্জভাবে বলছি এই
প্রশংসা সমানভাবে সোমেন মিত্রেরও প্রাপ্য। আর যাই হোক সোমেন মিত্র, মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈফুদ্দিন চৌধুরী, কানু সান্যাল, সুভাষ চক্রবর্তীদের মত
ব্যক্তিত্বদের করুণা করা যায় না। অনেকের কাছে শুনেছি সোমেন মিত্রকে দেখে অনেক
কংগ্রেসি নেতা, সমর্থক নিজেদের হাতে গড়ে তোলা সংগঠন ছেড়ে তৃণমূলকংগ্রেসে
গিয়েছিলেন। সোমেন মিত্র নীরবে এসব দেখেছেন। সহ্য করেছেন। অপমান হজম করে
চুপ করে ছিলেন। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাই তৃণমূলকংগ্রেস ছাড়ার সময়
সাংসদ হিসেবে পদত্যাগ করে কংগ্রেসে ফিরে আসেন। এটা তারিফ করার মত রাজনীতি। সততার
রাজনীতি। বিশ্বাসের রাজনীতি। নিজেকে প্রমাণ করার রাজনীতি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর
মাসে সভাপতি হিসেবে তিনি ‘ফেসবুক’- এ যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটা এই লেখায় কিছুটা তুলে দিচ্ছি। তাঁর মতো একজন প্রবীণ নেতা ‘ক্ষমা’ চাইছেন। ভাবা যায়? ভারতীয় রাজনীতিতে যেটা
ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
‘’যদি আমার প্রতি কারো কোনো ক্ষোভ- বিক্ষোভ থাকে
তাঁদের কাছেও করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলছি চলুন না একসাথে জোটবদ্ধভাবে আবার
লড়াই এ নামি আমরা।‘’ সংবাদ মাধ্যমে তিনি বলেন ‘’অতীতে দেখা গিয়েছে, তৃণমূলের সঙ্গে
জোট করে কংগ্রেসের সাময়িক লাভ হয়েছে। কিন্তু তার পরে আমাদেরই ঘর ভেঙ্গেছে। এখনও
পর্যন্ত পনেরোজন কংগ্রেস বিধায়ককে তৃণমূল ভাঙ্গিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁদের পদত্যাগ
করতে বলার নৈতিকতা তাঁরা দেখায়নি।‘’ সোমেনদা সংবাদ মাধ্যমে আরও বলেন, ‘’যারা চলে
গিয়েছেন। এখন তৃণমূলে আছেন, এমন অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছে। একা কিছু করা যাবে
না। অনেক মতপার্থক্য, ভুল বোঝাবুঝি সরিয়ে সবাইকে নিয়ে কংগ্রেস পরিবারের জন্য কাজ
করতে হবে।‘’
সিপিএম এবং কংগ্রেসের তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ
নেতাদের কাছে শুনেছি সোমেন মিত্র এবং অনিল বিশ্বাসের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল।
সংসদীয় গণতন্ত্রে যে ধরণের সম্পর্ক হয়ে থাকে। সোমেন মিত্র কোনদিন কংগ্রেস ‘ডিএনএ’
থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতি করতে চেয়েছেন এমনটা খুব একটা শোনা যায় না। ২০০৬ সালে
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমি যে সাক্ষাৎকার নিয়েছলাম সেদিন আমার
প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি সিপিএম আমলে এতদিন বিধায়ক থাকলেন কি করে?’ উত্তরে সোমেনদা
বলেছিলেন, ‘রসায়নটা হচ্ছে কংগ্রেসের রাজনীতি। শিয়ালদহ বিধানসভার মানুষ আমাকে চেনে।
আমি অঞ্চলের মানুষের প্রতিটি ঘরের লোককে চিনি ওই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে।
আর সিপিএমের সন্ত্রাসের সঙ্গে লড়াই করেই আমাকে জিততে হয়।‘’
খুব কিছু অপ্রাসঙ্গিক হবে না
হয়ত একটি লেখার কিছুটা অংশ উধৃতি হিসেবে উল্লেখ করলে। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘ভগ্নমুখ
শেকড়ছেঁড়া মন’ সংখ্যা ( ৭ মার্চ ১৯৯৮) ‘প্রজন্ম ব্যবধান তীক্ষ্ণ এবং ব্যাপক হতে
শুরু করলো ’৬৮ থেকে’ শিরোনামে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
লিখছেন, ‘’......না হলে যে প্রজন্ম প্রথম যৌবনে আগুনে ঝাপ দিল তাঁরা পরিণত বয়সে সব
চেয়ে চূড়ান্ত cultural regimentation, সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ ও বলবন্ধনের প্রণেতা
হলেন কী করে? নিজেরা যে-ব্যক্তিসাফল্যের পথ থেকে হেলায় সরে গিয়েছিলেন, শেষে সেই
পথে নিজেদের পুত্রকন্যাকে এত প্রবল বেগে নিক্ষেপ করলেন কেন? নিজদের জীবনের প্রথম
যৌবন ও প্রাথমিক প্রৌঢ়ত্বের মধ্যে এই সামুদ্রিক পরিবর্তন কেন? অথচ তাঁদের
পিতৃপ্রজন্মের মতো নিজেদের সন্তানদের মতিগতি না বোঝার হতাশাও এঁরা ব্যক্ত করতে পারবেন
না। তাঁদের যৌবনের সেই সব দিন ও অভিঞ্জতা কোনও আদর্শই নয় সন্তানদের কাছে।
মার্গারেট মিড মনে করেন যে, ষাট-সত্তর দশকের সঙ্গে আশি-নব্বই দশকের যে
জেনারেশন গ্যাপ, অত বড় প্রজন্ম বিচ্ছেদ
নাকি ইতিহাসে নেই। আমরা ষাটের দশকের ছাত্রকুল এটা হাড়ে হাড়ে টের পাই; পরের
প্রজন্মের মুখোমুখি আমরা এক রিক্তহস্ত শ্রেণী। (ব্যবধানে-ব্যাবধানে প্রজন্মও
শ্রেণী হয়ে যায়), আমাদের পূর্বের প্রজন্ম ও পরের প্রজন্মের মধ্যে আমরা মূর্ত
মূল্যবোধ সঙ্কট, সাত্রের ভাষায় এক চলমান স্ববিরোধ।‘’
শঙ্করলালদার লেখাটির এই অংশটি
বর্তমান সময়ের প্রজন্মের সঙ্গে আমরা আজও তুলনা করতে পারি। একুশ শতাব্দীর প্রথম
প্রহরে আমরাও আজ এক নতুন প্রজন্মের মুখোমুখি। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোট। রাজ্য
বিধানসভায় বিরোধী দল কংগ্রেস। আবার বিধানসভার বাইরে তৃণমূলকংগ্রেসের বিরোধী দল
বিজেপি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুযোগ নিয়ে বিজেপি নামক একটি সর্বভারতীয় দল সিপিএম
এবং বামপন্থীদের মহাজোট বিপিএমওকে ছাপিয়ে সামনের সারিতে চলে এসেছে। বিজেপির এই বাড়বাড়ন্তের
কারণ কারা? রাজ্য সিপিএম নেতৃত্ব বলছে তৃণমূলকংগ্রেস তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক আত্ম সমালোচনা করছেন। সীতারাম ইয়েচুরি ২০১৭
সালের ৫ মে কলকাতায় কার্ল মার্ক্সের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে এসে জানান,
বিজেপির কৌশল বুঝতে তিন বছর আগেই তাঁদের ভুল হয়েছিল। এবং সিপিএম দলের ব্যর্থতা যে
তার পরেও অব্যাহত রয়েছে সেটাও খোলাখুলি মেনে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে
কর্মী-সমর্থকদের সতর্কও করে দিয়েছিলেন। ইয়েচুরির অভিমত ছিল বামেদের ব্যর্থতার
জন্যই পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নিজেকে বিজেপির একমাত্র প্রতিদ্বন্দি
হিসাবে তুলে ধরতে পারছেন।
সিপিএম দলের মতাদর্শগত লড়াই এবং
আর্থিক উদারনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘’বিজেপি
২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে গুজরাত মডেলের কথা বলেছিল। গুজরাত কেন আদর্শ মডেল নয়,
সেটা বোঝাতে আমরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। অসীমবাবু (রাজ্যের প্রাক্তন
অর্থমন্ত্রি) গুজরাতের শিল্প, কৃষি বা মানবোন্নয়ন নিয়ে নানা তথ্য বার করেছিলেন। কিন্তু
গুজরাতকে ব্যবহারের পিছনে বিজেপির আসল উদ্দেশ্যটা বুঝিনি।‘’
২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে
জোট
সামনের বছর লোকসভা ভোটকে সামনে
রেখে তৃণমূলকংগ্রেস জানুয়ারি মাসে ব্রিগেডে জনসভার কথা ঘোষণা করেছে। ব্রিগেডে
সর্বভারতীয় বিরোধী নেতৃত্বকে একজোট করে নিজেদের মঞ্চে আনতে চান তৃণমূলনেত্রী।
তৃণমূলের ব্রিগেড জনসভায় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যোগ দেওয়ার আগে প্রদেশ
কংগ্রেসের মতামত নেবে। ৬ অক্টোবর কলকাতায় বিধান ভবনে একথা জানান কংগ্রেস মুখপাত্র
রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা। তিনি আরও বলেন, ‘’ব্রিগেডের প্রস্তাবিত জনসভা তৃণমূলের
নিজস্ব কর্মসূচি। সেখানে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কেউ থাকবেন কি না, তা ঠিক হবে রাজ্য
নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেই। গোটা দেশের জন্য একের বিরুদ্ধে একের সাধারণ কোনও
ফর্মুলা নির্ধারিত করা যাবে না। রাজ্যভেদে আমাদের অবস্থান ঠিক করতে হবে।‘’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন
মিত্র বলেন, ‘’তৃণমূল এখানে বিরোধীদের প্রতি স্বৈরাচারী মনোভাবই নিয়েছে। তাই
আমাদের কাছে জোটের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো।‘’
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধির
অগস্ট মাসের নির্দেশ ছিল, ‘বাংলার ৪২টা লোকসভা আসনের একটাও কংগ্রেস না পেলেও কিছু
এসে যাবে না। কিন্তু আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে জোট বা ভোট হবে না, সংগঠনের আগে
কোনও কিছুর অগ্রাধিকারও থাকবে না।’ প্রদেশ সভাপতির বক্তব্য থেকেও সেই ইঙ্গিত পাওয়া
যাচ্ছে। তাহলে কি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস একটাও আসন পাবে না? রাজনৈতিক
পর্যবেক্ষকদের অভিমত অবশ্য ভিন্ন। তাঁরা বলছেন বর্তমানে কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা
চারজন। একজন রাজ্যসভার সদস্য। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই রাজ্য থেকে কংগ্রেসের আসন
সংখ্যা বাড়তে পারে। সেই সংখ্যা বাড়ার ক্ষেত্রে কারা অদৃশ্য সাহায্য করবে সেটা এখনই বলা
সম্ভব নয়। তবে জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবে এবং রাজ্যে বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূল
কংগ্রেস এগিয়ে আস্তে পারে। আবার সিপিএমের নেতৃত্বে বামেদের একটা অংশ গোপন বোঝাপড়ায়
কংগ্রেসকে সাহায্য করতে পারে। ২০১৯ সালের লোকসভায় কংগ্রেস দলের সাংসদ হিসেবে সোমেন
মিত্রকে দেখতে পেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। বর্তমান সময়ে বাংলার কংগ্রেস কর্মীরা
৭৫ বছরের এক প্রবীণ পোড় খাওয়া নেতার হাতে নিজেদের সমর্পণ করেছেন।
No comments:
Post a Comment