Thursday, 27 September 2018

রাজনীতির সৌজন্য সৌজন্যের রাজনীতি


দীপেন্দু চৌধুরী
পুজোর বাজার শুরু হয়ে গেছে। বাজার সরগরম। একদিনের দুপুবেলা। গোলপার্কের লাইব্রেরি যাচ্ছি। গড়িয়াহাটের একজন হকার দ্বিতীয় এক হকারকে বলছেন, ‘’এই মহাজাগতিক ঢপ মারিস না।‘’ বিষয়টা কী ছিল বলতে পারব না। তবে ভদ্রলোকের কথাটা আমার ভালো লেগেছে তাই মনেও রেখেছি। ঢপ আমরা সবাই মারি। জাগতিক মহাজাগতিক ঢপ কি হতে পারে অনুসন্ধান না করে বলা সম্ভব নয়। আমার এক বন্ধুর ভায়ের মেয়ে বছর কয়েক আগে একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে দুপুরের নেমন্ত্রণ খেতে গেছে। তখন বাচ্চা মেয়েটির বয়স হবে তিন থেকে চার বছরওর থেকে কিছুটা বড় কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেই বাড়ির খাটের তলায় রেখে দেওয়া ‘চাটনি’-র গামলা টেনে নিয়ে সবাই মিলে হাতা দিয়ে একটু একটু করে খাচ্ছিল। আমার বন্ধুর ভাইয়ের স্ত্রী দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওদের এসব করতে নিষেধ করেন। নিজের মেয়েকে জিগ্যেস করে, ‘’পৃথা তুমি এসব কী করছ? পৃথা উত্তর দিয়েছিল, ‘’মা আমি ঝাড়ি করছি। ঝাড়ি করে খাচ্ছি।‘’ বন্ধুর ভায়ের স্ত্রীয়ের কাছে শোনা। ভদ্রমহিলা আমাকে বলেন, ‘’দাদা আমি ভেতরে ভেতরে হাসছি। কিন্তু ওদের সামনে ছদ্ম গাম্ভীর্য বজায় রেখে উত্তর দিতে হয়েছিল, আচ্ছা ঠিক আছে। এবার সবাই চল খেয়ে নেবে। পরে মেয়েকে বলেছিলাম পৃথা এইসব শব্দ বা কথা বলতে নেই। মেয়ে উত্তরে বলেছিল ‘দিদি’-দের কথা তুমি আমাকে শুনতে বলেছ। এর পরে কী বলব আমি বলুনতো?’’
বিষয়গুলি কতটা সামাজিক হলে আমাদের শুনতে হয়। অথবা কতটা অসামাজিক হলে আমাদের দূরত্ব রাখতে হয়। সম্প্রতি আমদের শহরের একটি পাড়ার চায়ের দোকানের মালিক, বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। দোকানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সের খদ্দেরদের বলছে, ‘না ওই ছেলেগুলো আর আসে না। আমি ওদের বলেছি যতক্ষণ বাজে আড্ডা মারবি সেই সময়টা বাড়িতে বাবা-মায়ের পা টিপে দিবি। বলুন কিছু খারাপ বলেছি?‘’
আমাদের বিষয়টিও উল্লেখিত তিনটে বিষয়ের খুব কিছু উর্ধে নয়। আমাদের দেশে গত দু’তিন দশক রাজনীতি নামক কঠিন এবং বিষম এক বিষয়ে ‘সৌজন্য’ কতটা আছে? বিরোধী দলের সঙ্গে সরকার পক্ষের ‘সৌজন্য’ অথবা উল্টোদিকে সরকার পক্ষের লোকেরা নিজেদের কতটা সামনে এগিয়ে আনতে পারেন বিরোধী দলের সঙ্গে ‘সৌজন্য’ মূলক আলাপচারিতায়? সম্প্রতি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে দু’জন (উত্তর বঙ্গের রায়গঞ্জে) ছাত্রের পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর প্রতিবাদে একটি ১২ ঘণ্টার বাংলা বনধ হয়ে গেল। বনধ ডেকেছিল কোন দল? বিজেপি। বাংলা বন্ধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বনধের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের বন্ধের দিন (২৬ সেপ্টেম্বর)-এর প্রভাবের ফারাক কিছুটা নজরে পড়েছে। কিন্তু আমাদের এই বিষয়ের সঙ্গে একদিনের ‘বনধ’ খাপ খায় কী? হ্যা সাযুজ্য আছে। কারণ এটাও সৌজন্যের রাজনীতি এবং রাজনীতির সৌজন্যের মধ্যে পরে। গত সাত বছরে বামপন্থীদের অবস্থা সারা ভারতে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। বিষয়টা আমরা কলাম লিখিয়ে এবং নিরপেক্ষ, নির্ভীক সাংবাদিকের দল বলছি তথাকথিত বামপন্থীদের কয়েকজন নেতার যদিও আমাদের মতামতের কোন মূল্য নেই। তাঁদের নাক এতটাই উঁচু। যে কেউ সমালোচনা করলে ‘উগ্র হিন্দু’ বলে দেগে দিতে তাঁদের সময় লাগে না। অথবা ‘পাগলা বাবা’ এবং ক্যামেরাম্যান সময়ের মানদণ্ডে বর্তমান সময়ে প্রতিটি সাংবাদিক, লেখককে ক্যামেরাম্যন হতে হয়। যে সামাজিক কর্পোরেট ব্যবস্থা দু’দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে। তিনি বা তাঁরা এসব খবর রাখতেন না।
ভারত তথা বাংলার বামপন্থীদের দায়িত্বের কথা আমাদের মত অখ্যাত কলমচির দল বলছি এমনটা নয়। প্রখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা সমাজবিঞ্জানী অমর্ত্য সেন সম্প্রতি একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আবার বলেছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন বামপন্থীদের ঐতিহাসিকভাবেই গতিশীল সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে।  
গত সাত বছর আমাদের বাংলায় পরিস্থিতি সব থেকে জটিল। কংগ্রেসের রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং ৩৪ বছরের শাসক সিপিএম তথা বামফ্রন্টের ঘরানায় রাজনীতি শেখা দল তৃণমূলকংগ্রেস বর্তমানে রাজ্যের শাসকদলরাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে এবং শিল্পপতিদের আস্থা যোগাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনধ রাজনীতির বিরোধী। যে কারণে তিনি ইতালির মিলান শহর থেকে বাংলা বনধের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘’বনধের বন্ধ্যা রাজনীতি বাংলার মানুষ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতঞ্জ।‘’ বামফ্রন্টের আমলে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে কোনও বনধের বিরোধিতা করেছেন। বাংলার উন্নয়নের প্রশ্নে। বিজেপি নিজেদের দলের কর্মীসমর্থকদের চাগাতে লোকসভা ভোটের আগে দু’জন ছাত্রের মৃত্যুকে বিষয় করে ‘বাংলা বনধ’ ডেকে বাংলার মানুষের অবস্থান জেনে নিতে চেয়েছিলরাজনীতির পরিভাষায় তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া দেখা মানে গাঁধিজী বা লেনিনের কথায় মানুষের কাছে যাও। তাঁদের রায় নাও এবং তত্বে প্রয়োগ কর। বিজেপি বাংলার মানুষের রায় বুঝে নিতে চাইল। সামনে লোকসভা ভোট। বিজেপির টার্গেট ২২ জন সাংসদকে নির্বাচিত করে দিল্লি পাঠানো। পরে আসছে ২০২১ বিধানসভা ভোট। তত্বের প্রস্তুতির মঞ্চে বিজেপি কাদের সাহায্য নিয়ে থাকে? তাঁদের দলের মেরুদন্ড ‘আরএসএস’ নামক একটি শক্তিশালী সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যাঁদের সাহায্য ছাড়া ‘বিজেপি’ দলটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
২৬ সেপ্টেম্বর বিজেপির ডাকা বাংলা বনধ সফল বলা যাবে না। তবে শাসক তৃণমূল দলকে তথা প্রশাসনকে  একটা ধাক্কা দিতে পেরেছে বলেই বিশেষঞ্জদের মত। বিজেপি বনধের দিনটা বেছে নিয়েছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলকংগ্রেসের অন্যতম মেরুদন্ড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতির দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ দিনের বিদেশ সফরে। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি জার্মানী গেছেন পরে ইতালি। ঠিক এই সময়ে রাজনীতির সৌজন্যে বিজেপি এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে। বিজেপির ডাকা বনধের দিন বামপন্থী দলগুলি রাস্তায় ছিল বনধকে সমর্থন না করেও। দু’জন ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে সৌজন্যের রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতে তারমানে আমাদের ধরে নিতে হবে সিপিএম, প্রদেশ কংগ্রেস এবং বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসকে নয়। আসলে আমি কি ডরাই সখি রাখবে? আমি এবং আমরা ডরাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নেত্রী এবং প্রশাসক হিসেবে। কারণ মমতার প্রত্যুৎপন্ন রাজনীতি তথা সৌজন্যের রাজনীতির অন্যতম উদাহারণ। চলতি বছরের ১৬ জুলাই মেদিনীপুর শহরের কলেজ কলেজিয়েট মাঠে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় ছাউনি ভেঙে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনায় কয়েকজন বিজেপি সমর্থক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর দলের আহতদের দেখতে যাবেন এটাই রাজনীতির সৌজন্য। সমাজবিঞ্জান এই দাবি করে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ওইদিনের দুর্ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে দেখতে গেলেন। পাশাপাশি আহতদের নিজের ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্যও করলেন। এটাকে কি বলা যায়? রাজনীতির সৌজন্য না সৌজন্যের রাজনীতি?   
আবার এটাও মানতে হবে গত সাত বছরে তৃণমূল প্রশাসনের মন্ত্রীরা অনেক পরিণত। তুলনামূলকভাবে অনেক শান্ত, ধীরস্থীর। অনেক কৌশলী। এটার অন্যতম উদাহারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতে তাঁর গড়ে দেওয়া ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’-র মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়া এবং বাংলা বনধের মতো দু’টি বড় ঘটনাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা। কয়েকজন নেতা মন্ত্রীর প্রথম দিকের নতুন ক্ষমতা পাওয়ার ছদ্ম অহংকার এবং তথাকথিত ‘আবেগ’ কেটেছে। কাটছে। এটাই দক্ষতার লক্ষণ। তাঁদের কর্মীসমর্থদের মধ্যে একটা তথাকথিত ঔদ্ধত্য এসেছে। সেই কারণে সমাজে একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসর তৈরি হচ্ছে। অত্যন্ত জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘সোশ্যাল মিডিয়ায়’ সুযোগ পেলেই বয়সে বড় মানুষকে হেয় করা। অপমান করা। অকারণে ‘তুই’- ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা। তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে তথাকথিত এক ছাত্রনেতা (আদৌ তৃণমূলের লোক কি সে?), একজন কাঠের মাথা তথকথিত কবি, (সে এখনও আছে। দলে থাকলেও সেও কি তৃণমূল করে?) এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে সৎ, নিরপেক্ষ সাংবাদিক, লেখকদের ‘ভাম’ বলে দেগে দেওয়া হত। মহাকরণ, নবান্ন, প্রেসক্লাব, তৃণমূল ভবনে সুযোগ পেলেই অপমান করা হত। ‘তুই’ বলে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে।  ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের কয়েকদিন পরে ‘বাংলা অ্যাকাদেমী’তে আমাকে নোংরা অপমান করার চেষ্টা হয়েছিল। সম্ভব হয়নি অ্যাকাদেমির আধিকারিকদের সৌজন্যে। আমাকে অপমান করার পেছনে ছিল ওই কাঠের মাথা কবি। যে বালখিল্যসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি সেদিন বাংলা অ্যাকাদেমির সভাপতি শাওলী মিত্রের একটি সাক্ষাৎকার আনতে গিয়েছিলাম। যে সাক্ষাৎকারটি পরে বাংলা নাটকে পাঁচজন নারীর অবদান নিয়ে আমার একটি লেখায় প্রকাশ হয়। লেখাটি রাজ্য সরকারের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার ‘সিঙ্গুর’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে
পঞ্চায়েত, পুরসভা এলাকায় মানুষ বামপন্থীদের অনুপস্থিতিতে নতুন পরিসর খুঁজছে। তৃণমূল কংগ্রেস দলে এবং সরকারে এত বেশি ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’-র চর্চা হচ্ছে অনেকে বামফ্রন্টের শেষ দশকের সঙ্গে তুলনা করছে। গত ১৫ অগস্ট কলকাতা প্রেস ক্লাবের মধ্যহ্নভোজের অনুষ্ঠানে কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত প্রবীণ সাংবাদিক বিষয়টা নিয়ে চর্চা করছিল। তাঁরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশাসক হিসাবে নম্বর দিলেও তাঁর দলের ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’-র বিষয়ে সন্দিহান। আমি সেদিন যুক্তি দিয়েছিলাম কিছু নেতা মন্ত্রী ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’ থেকে বেরিয়ে আস্তে চাইছে। আমার বলা কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় পরিবহনমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর শিশুসুলভ রাজনীতির পর্ব পার হয়ে আসা। উত্তর নন্দীগ্রাম এবং জঙ্গলমহল আন্দোলনের সময় যে আবেগ তাড়িত রাজনীতির চর্চা তিনি করেছেন তাঁর খেসারত তাঁকে জাতীয় এবং স্থানীয় ক্ষেত্রে দিতে হয়েছে। বনধের দিন ২৬ সেপ্টেম্বর ইসলামপুর শহরে জনসভা করলেও মৃত দু’ই ছাত্রের বাড়িতে যাননি। আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটাকেও রাজনীতির সৌজন্যের মধ্যেই দেখতে হবে। ২৬ সেপ্টেম্বরের সভা থেকে তৃণমূলের যুবনেতা বলেন, ‘’নিহত রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মণের পরিবার যে ধরণের ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য চাইবেন, তাই নিয়েই তাঁদের পাশে দাঁড়াব। দাড়িভিটের ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। হত্যাকারীদের শাস্তি হোক।‘’ পরিবহণমন্ত্রী আরও বলেন, ‘’কয়েক দিনের মধ্যেই রাজেশ এবং তাপসের বাড়িতে যাব। তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।‘’ সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর রাজ্য সরকার দু’ই ছাত্রের মৃত্যুর তদন্তভার সিআইডির হাতে তুলে দিল।
‘’দাড়িভিট তদন্তের দায়িত্ব নিল রাজ্য সিআইডি। বৃহস্পতিবারই রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশে, ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত জেলা পুলিশের কাছ থেকে সিআইডিকে দেওয়া হয়।
জেলা পুলিশ উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে দাড়িভিট উচ্চবিদ্যালয়ে দুই ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র এবং গ্রামবাসীদের সংঘর্ষের পৃথক মামলায় জেলা পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও এখনও কোনও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি’’ (সূত্রঃআনন্দবাজার ডিজিটাল)
আলিঙ্গনের রাজনীতি এবং সৌজন্য
আমাদের দেশে লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশন চলাকালীন কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ রাহুল গাঁধি অনাস্থা প্রস্তাবের উপর একটি আগুন ঝরানো বক্তব্য রাখেন। এর পরের ঘটনাটির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। বক্তৃতার পরে রাহুল গাঁধি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। যে ব্যবহারের জন্য পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক নরেন্দ্র মোদী প্রস্তুত ছিলেন না। ২০ জুলাই সংসদে বক্তৃতার শেষে রাহুল বলেন, ‘’আপনাদের অন্তরে আমার প্রতি ঘৃণা থাকতে পারে। আপনারা আমাকে পাপ্পু বলে হাস্যস্পদ করতে পারেন, গালি দিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার অন্তরে আপনাদের প্রতি একটুও রাগ বা ঘৃণা নেই! প্রধানন্ত্রীর বিরুদ্ধেও কোনও বিদ্বেষ নেই। আমি এক এক করে আপনাদের অন্তর থেকেও ভালবাসা বার করে আনব।‘’ রাহুল গাঁধির এই আচরণ নিয়ে তর্ক বিতর্ক যতই হোক বা থাক এটা ইতিহাসে চলে যাবে। কারণ আমরা ভারতীয়রা নমস্কার বিনিময়, আলিঙ্গন করা এইসব সংস্কৃতিকে রাজনীতির ময়দানে দেখতে অভ্যস্ত নই। এটা ভারতীয় সংস্কৃতির সৌজন্যমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে। যেমন পূর্ব ভারতের দুর্গা পূজোর পর বিজয়া উপলক্ষে নমস্কার করা এবং কোলাকুলি করে আলিঙ্গন করা। ঈদের পরেও এই সংস্কৃতি আমরা দেখেছি। জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায়, ধনী, নির্ধন কোনও ভেদাভেদ না রেখে ‘কোলাকুলি’ সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক সনাতন সম্পর্ককে আরও অটুট রাখে।  যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে রাহুলের প্রতুৎপন্ন সামাজিক সংস্কৃতিকে শ্লেষ করতে ছাড়েননি। ২০ জুলাই সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘’কুর্সিতে বসার এত তাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে উঠে বলেন, উঠে দাঁড়াও! উনি জানেন না, এই কুর্সিতে বসতে যোগ্যতা লাগে। দেড়শো কোটি ভারতবাসীর আশীর্বাদ লাগে।‘’
বিষয়টা এখানেই থামল না। রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস আর্থিক প্রতারণায় অভিযুক্ত শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিক আক্রমণ করে যাচ্ছে। ২৯ জুলাই লখনউ বিনিয়োগ কারীদের একটি সম্মেলনকে বেছে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, ‘’দেশের উন্নতিতে অংশ নেওয়া শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়াতে আমি ভয় পাই না। কারণ আমার অভিপ্রায় সৎ।‘’ প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরও বলেন, গাঁধিজীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল। তাই তিনি বিড়লাদের বাড়িতে থাকতেও দ্বিধা করেননি। যদি তোমার উদ্দেশ্য ভাল ও সৎ হয়, তা হলে যে কারও সঙ্গে ছবি তুলতেই পার। এতে চরিত্রে কোনও দাগ পরে না।‘’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উত্তরের প্রতিক্রিয়া পেলাম দু’জন ইতিহাসবিদের কাছ থেকে। আমরা সংবাদ মাধ্যম মারফৎ তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারলাম। সাংসদ-ইতিহসবিদ সুগত বসু বলেন, ‘’আশা করি উনি নিজেকে মহাত্মা গাঁধি ভাবতে শুরু করেননি। উনি নিদেনপক্ষে দীনদয়াল উপাধ্যায়ও নন। বিড়লা সম্বন্ধে সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি।‘’
ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী বলেন, ‘’বিড়লা গাঁধিকে টাকা দিতেন। গাঁধি বছরশেষে পাইপয়সার হিসেব দিতেন। মোদী শিল্পপতিদের থেকে কত টাকা নেন, সেই হিসেব যদি তিনি জানান, তা হলে অসুবিধা ছিল না।‘’ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতিতে ফরাসি যুদ্ধবিমান ‘রাফেল’ নিয়ে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখেই একটার পর একটা আক্রমণ করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। আজ সিপিএম পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাঁদের দাবি ফরাসি সংস্থা ‘দাসো অ্যাভিয়েশন’-এর রাফাল বিমান সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছে সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গঠন করতে হবে। রাফাল নিয়ে বিতর্ক এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছে বাধ্য হয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ বিবৃতি দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি সেই বিবৃতিকে লুফে নিয়ে নতুন ভাষায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছেন। এই বিষয়টাকে কি বলা যায়? রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক সৌজন্যের বাধ্যবাধকতা?
রাজনীতির সৌজন্য এবং সৌজন্যের রাজনীতিকে প্রসঙ্গ করে কয়েকশো পাতার একটা বই লেখা যায়। ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করে এই বই গবেষকরা লিখতে পারেন। উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ ইউরোপের অতীত এবং বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের নাম এবং তাঁদের কাজের তথ্যসাবুদের ঘটনা উল্লেখ করে এই বই লেখা যায়। আমাদের দেশেও মহাত্মা গাঁধি, পণ্ডিত নেহরু, নেতাজী সুভাষ বোস, জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধি সহ একাধিক প্রথমসারির রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আলোচ্য বিষয়ে একটি প্রামাণ্য দলিল লিখে ফেলা যায়। তরুণ প্রজন্মের নেতাদের কাছে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের সৌজন্যের রাজনীতি এবং সংস্কৃতি আশা করলে কি খুব ভুল কিছু প্রত্যাশা করা হবে? শ্যামধারীদের বাড়িতে বাঁশের সরু বাতা দিয়ে বাঁধানো ক্যালেন্ডারে ‘সত্যমেব জয়তু’ লেখা এক সভ্যতায় আমার দেশ দেখা হয়েছিল। শ্যামধারীকেও আমি ‘আপনি’ সম্বোধন করে আলিঙ্গন করেছিলাম। কোলাকুলি করেছিলাম। ওদের বাড়িতে আমার গাঁধির দেশ দেখা হয়েছিল। আজ বলি আমি এবং আমরা ‘সত্যমেব জয়তে’-র দেশে সাংবিধানিক সৌজন্য সকলের থেকে আশা করি।          

No comments:

Post a Comment