দীপেন্দু চৌধুরী
ছোট ছোট ঘটনার, ছোট ছোট কথার বিনিসুতোর মালা গেঁথে গড়ে ওঠে ‘ছোট গল্প’-এর খন্ড চিত্র। একটা সফল ছোট গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় যা শেষ হয়েও হয় না শেষ। আমি একজন লেখকের কথা জানি ১২ টা ছোট গল্প নিয়ে ২১ বছর অপেক্ষা করছেন। ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশ করার জন্য। আবার বলতে পারি ‘যা শেষ হয়েও হয় না শেষ’। সেই স্বঘোষিত লেখক ২০১৪ সালে আবার একটা বিনিসুতো টেনে নিয়ে মালা গাঁথতে শুরু করেছিল। না শেষ হয়নি। ছোট ছোট কথা ছোট ছোট খন্ড চিত্র বড় হয়ে থেমে গেল। থেমে রয়েছে। যা শেষ হয়েও হয়নি। এটাও একটা ছোট গল্প হতে পারে। ‘সাত সাগর আর তের নদীর উপাখ্যান’-র কথা সম্প্রতি একটি চিঠিতে লিখেছি। আজ আবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ২১ টা রঙিন সুতো আর ১২ টা সাগরের ঢেউ গোনার চিত্র মালার উপাখ্যান। কিন্তু সময় কোথায়? সামাজিক অবসর কোথায়? সামাজিক ছাড়পত্র, সামাজিক স্বীকৃতি, আর্থিক সহায়তা, সক্ষমতা এতগুলির এবং ছোট গল্পের লেখকের জনপ্রিয়তা থাকলে তবে না এগতে পারা সম্ভব! আপনি বা আপনারা কি বলেন?
আমরা ছোট গল্প, বড় গল্প, উপন্যাস এসবের ইতিহাস বা কাহিনি শোনাতে চাইছি না। সাহসও নেই, দায় আছে। দায়িত্বের কথা সমাজ ভাবতে শেখাবে। আজ আমরা পাঁচটা খন্ড খন্ড হ্রদয়ের থুড়ি পাঁচজন চলচ্চিত্র শিল্পীর কথা বলতে এসেছি। পাঁচটা ছোট ছবি দেখার বিষয় আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার এই গৌরচন্দ্রিকা। সম্প্রতি কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে ই-মেলে একটি আমন্ত্রণপত্র পাই। ২৯ অগস্ট সন্ধ্যে ৬টায় পাঁচটি ছোট ছবি বা ‘সর্ট ফিল্ম’ দেখার সঙ্গে তিন্নি ভট্টাচার্যের আলাপন। আমার ধারণা ছিল তিন্নি ভট্টাচার্যের নিজের তৈরি পাঁচটা ছোট ছোট ছবির ঠাসবুনোট মালার বহু বর্ণের গ্রন্থন দেখতে পাব। কিন্তু ই-মেলের বিষয় থেকেই জানতে পারি পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন পরিচালকের পৃথক পৃথক ছবি। আমরা জানি ‘চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা’ যদি না পড়ি ধরা। আসুন আমরা সৌজন্য বজায় রেখে কিছুটা ফাঁকিবাজির রাস্তায় হাঁটি। একটু চুরি, না চুরির কাছাকাছি ছোট ছোট শব্দ, বাক্য আড়াল থেকে সামনে নিয়ে আসি। আমি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, কলকাতার পাঠানোর ই-মেলের বয়ানটা এখানে ছেপে দিতে চাইছি। আপনাদের রাগ হবে নাতো? অবঞ্জা করবেন? কি আর করা যায় বলুন ওই যে চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা। ফাঁকিবাজ শুনতে হবে। কত কথা শুনতে হয়। শুনতে হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগিয়ে আসা। ছোট্ট চোট্ট চোট্ট শব্দের চাপানউতোর, টানাপড়েন শুনতে শুনতে বড় হওয়া। নাগরিক কলকাতায় জলনুপূরের তা তা থৈ থৈ, তা তা থৈ থৈ দেখতে দেখতে সামনে আসা। তাই অপেক্ষা না করে ছেপে দি। আপনারা কী বলেন?
Join us for the screening of a series of short films followed by an interesting seminar with film director Tinni Bhattacharya.
The topic of discussion is Technology vs. Concepts in the film.
'Film as an Art' cannot survive without technology. To create film 'ideation' does not suffice; it is backed up by various technical tools- camera, editing, etc.
While watching any film are we moved by the technical inputs or the conceptualization? Or both? In this new era of technology, it may seem like the idea is lost, and that it is the technical gimmick which is taking over..
Programme:
1) Aissa by Clément Tréhin-Lalanne (2014, 8 min)
2) Le Banquet de la Concubine (2012, 13 min)
3) Blindspot by Simon Rouby (2014, 3 min, Animation)
4) Le Bucheron des mots (2009, 11 min, Animation)
5) Les chiens isolés by Rémi Bastie (2011, 6 min. Animation)
6) Brises by Enrique Ramirez (2008, 13 min)
7) La Chair et les volcans (2014, 20 min)
1) Aissa by Clément Tréhin-Lalanne (2014, 8 min)
2) Le Banquet de la Concubine (2012, 13 min)
3) Blindspot by Simon Rouby (2014, 3 min, Animation)
4) Le Bucheron des mots (2009, 11 min, Animation)
5) Les chiens isolés by Rémi Bastie (2011, 6 min. Animation)
6) Brises by Enrique Ramirez (2008, 13 min)
7) La Chair et les volcans (2014, 20 min)
About Tinni Bhattacharya
"I have been exposed to Worldwide Advertising from a very tender age. As a film scholar, I have contributed articles in some of the leading newspapers of the country. In 2013 I made a short film named ‘Indispensables’, which was shown at the Kolkata International Film Festival, and Delhi International Film Festival.
Now I am working on my next script and teaching Film and Advertising as a freelance lecturer in various institutes. Along with this, I am engaged in conducting workshops in different cities across the world such as Bangalore, Kolkata, and Paris."
অনুষ্ঠানের শুরুতেই দক্ষ এবং অভিঞ্জ পরিচালক তিন্নির বক্তব্য থেকেই আমরা বুঝে যাই হেমন্তের কলকাতার সন্ধ্যেয় গঙ্গাবক্ষের পশ্চিমের হাওয়ার মেদুর আদর আমরা পেয়ে যাব। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সামাজিক আন্দোলন, সামাজিক বিক্ষা ইত্যাদি। চিত্রভাসের ক্যানভাস বনাম আধুনিক কারিগরি। হ্যাঁ শুরতেই তিন্নি আমাদের বললেন, ‘’আমরা কেন সর্ট ফিল্ম করি? বাজেট একটা বিষয়। ২লাখ ৩ লাখ টাকায় ডিজিটাল ছবি হয়ে যায়। watch Film and get social values. ও হেনরি যেমন উপন্যাস লেখেন। আবার ছোট গল্পও লেখেন। সিনেমা বিষয়টা তেমন নয়। How people are getting film? আমার প্রশ্ন। সামাজিক মূল্যবোধের গল্প আছে এমন ছবি আমাদের দেখতে ভালো লাগার কথা।‘’
এর পরে আমরা একটা করে ছবি দেখি আর তিন্নি আমাদের সামনে আসেন। না তিনি তাঁর লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ঞ্জানের কথা বলতে আসেননি। তিনি আমাদেরমতো দর্শকদের সঙ্গে সংলাপ করলেন। আমাদের কথা শুনলেন। তারপর নিজে ব্যখ্যা দিলেন প্রতিটি ছোট ছোট ছবির গল্প, ডিটেলিং, চরিত্র, অভিনয়, সামাজিক প্রেক্ষাপট, আধুনিক কারগরি, প্রতিটি বিষয়ে বললেন। তিনি আমাদের অভিঞ্জ শিক্ষক বন্ধুর মতো করে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা দর্শকরা আন্তরিকভাবে ‘মত বিনিময়’ সভায় অংশ নেওয়ার সাহস পেলাম।
আমরা দুটো ছবি বেছে নিচ্ছি আলোচনার জন্য। Aissa শিরোনামে প্রথম ছবি। পরিচালক Clément Tréhin-Lalanne ,ফরাসী সংস্কৃতির ধ্রুপদী ভাষায় চলচ্চিত্রের বুনোটে ছবিটির বক্তব্য আমাদের সামনে তুলে দিয়েছেন পরিচালক। ছবি শুরু হচ্ছে একজন কালো যুবতি মেয়েকে সামনে রেখে। নাম আইসা। কোনও ‘পরিচয়পত্র’ মেয়েটির কাছে নেই। সে বিউটিশিয়ান। মেয়েটি একটি ল্যাবে শারীরিক পরীক্ষা করতে এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ওজন নেওয়া হয়, মেয়েটি নিজে জানায় তাঁর বয়স সতেরো বছর। সেইমতো তাঁর শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা শুরু হয়। ক্যামেরা এবং ক্যামেরা পরিচালকের জাদুর সামনে কালো চামড়ার মেয়েটি একটি সুডৌল স্তন পরীক্ষার জন্য দেখায়। শিল্পের দাবি মেনে সে একটা একটা করে পোশাক খুলতে থাকে। ছোট ছবির ছোট ছোট কথার মতো। ছোট ছোট শব্দের মতো, ছোট ছোট দেশী-বিদেশী বহু বর্ণের মতো করে সে পোশাক খুলতে থাকে। গম্ভীর গভীর নদীর শান্ত ঢেউয়ের মত সদ্য যুবতী মেয়েটি তাঁর পোশাক খুলতে থাকে। না ক্যামেরা কোনরকম বেয়াড়াপনা করেনি। শিল্পের দাবি মেনে ক্যামেরা চালিয়েছেন পরিচালক।
মেয়েটির হাড়, পেশির পরীক্ষা করার পর জানা যায় মেয়েটির বয়স ২০ বছর। এবং এর পরে মেয়েটি আবার টুকরো টুকরো শব্দের মতো, টুকরো টুকরো সেলুলয়েডের ফিল্মের মতো, ছোট ছোট ফ্রেমের মতো নিজের পোশাক পড়ে নেয়। প্যাথলজিক্যাল কেন্দ্র থেকে সে যখন চলে যায়, নিজের ‘ব্রা’ বা ‘বক্ষআবরণী’ না পরে হাতে নিয়ে চলে যায়। আমরা জানতে পারি সে এসেছিল বা বা রাষ্ট্র তাঁকে আসতে বাধ্য করেছিল দেশের অভিবাসন দপ্তরে। ইমিগ্রেসন ডিপার্টমেন্টে। তারপর?
২০১৪ সালে তৈরি মাত্র ৮ মিনিটের ছবি। মাত্র ৮ মিনিটে এত কথা বলা যায়? এই ছবি না দেখলে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে উঠত না। কতটা দক্ষতা, দেখার অন্তর্দৃষ্টি থাকলে তবেই বোধহয় সম্ভব হয় এমন একটা ছবি নির্মাণের। পরিচালক নতুন ভাষা উদ্যান থেকে আমাদের বিশ্বের এক চেনা, এক অচেনা ছোট গল্পের সন্ধান দিলেন।
দ্বিতীয় ছবিটি চিনের একটি রূপকথার গল্পকে অবলম্বন করে তৈরি। Le Banquet de la Concubine শিরোনামের ছবিটির সুর বাঁধা ছিল ‘অপেরা মিউজিক’-এর তাল লয় ছন্দে। সম্রাটের পরিবার এবং তাঁর জীবন যাবনকে কেন্দ্র করে এক সামাজিক টানাপড়েন। একজন নারীর অবসাদ। অসাধারণ গ্রাফিক্স বর্ণনা উঠে এসেছে পরিচালকের সূক্ষ অনুভবী ভাষায়। পরের ছবি তিনটিও বর্তমান সমাজের সমস্যা কেন্দ্রিক, তাঁর মধ্যে অন্যতম ‘সমকাম’, ড্রাগস এবং চাকরি না পাওয়া বর্তমান প্রজন্মের গোপন দৈনন্দিন জীবনের ছন্দের গল্প। পরিচালক ত্রয়ী আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এইসব আধুনিক জ্বলন্ত বিষয়ের সঙ্গে। এছাড়াও ছিল আরও অন্যান্য সামাজিক প্রেক্ষাপট।
দু’টি ছবি দেখার পরে আমাকে বলতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেদিনের আমার দেখা কলকাতার দু’টো অভিঞ্জতার কথা বলেছিলাম।
২৯ অগস্ট গোধূলি সন্ধ্যে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। একটু আগে ফরাসী কবিতার শব্দে মধ্য কলকাতায় শরতের বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। শরতের নীলাভ আকাশের আড়াল থেকে বৃষ্টি এসেছিল। জীবনানন্দের কাব্যের গোধূলি সন্ধ্যে ছিল সেদিন। শম্ভু মিত্রের কন্ঠের আনুনাসিক শব্দের মতো আমরা বৃষ্টির শব্দ পেয়েছিলাম। আমি মেট্রো রেলে এসে পার্কস্ট্রীট স্টেশনে নামলাম। আমার সামনে একজন মধ্য চল্লিশ বয়সের মহিলা। মধ্যবিত্ত বলি অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত। ভদ্রমহিলা ট্রেনের টোকেনটা এক্সিট ভেন্ডার যন্ত্রে কি ভাবে দিতে হয় জানতেন না। আমি বলে দিলাম। তিনি বাইরে গেলেন। পাশের ভেন্ডিং যন্ত্রে লাল রঙ দিয়ে ক্রস (X) চিহ্ন দেওয়া রয়েছে। সেই গেট দিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। ভদ্রলোক জানতেন না। বাইরে বসে থাকা নিরাপত্তা কর্মীরা আমরা যে গেট দিয়ে বাইরে এলাম ভদ্রলোকটিকে সেই গেট দেখিয়ে দিলেন। স্বামী-স্ত্রী বাইরে এলেন। মহিলা বললেন, ‘’পয়সাটা কোন ঠায় দিবার লাগে জানতাম না।‘’ স্বামী উত্তর দিলেন, ছয়মাস পর আইলামতো সব ভুইলা গেসি গিয়া।‘’ জানি না ওই দম্পতি উত্তরপূর্ব ভারতের কোনও রাজ্য থেকে এসেছেন না বাংলাদেশ থেকে? অভিবাসন সমস্যা? না নাগরিক পঞ্জি?
স্টেশনের বাইরে এলাম। কলকাতা পুলিশ ক্লাব। ফুটপাথ। বড় রাস্তা। আবার পরের ফুটপাথ। ফুটপাথে হাঁটুজল নেই। ফুট পাথে একটা পরিবার। রাস্তায় কিছুটা কালো কাদা জল। কাদা জল থৈ থৈ করছে। ফুটপাথের ওই পরিবার থেকে একটি সাত-আট বছরের বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এসে জল নিয়ে খেলা করছিল। ওর কাছে জলনুপূরের খেলা। আমাদের মতো তথাকথিত ভদ্রলোক দেখলেই পায়ে করে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার কালো তেল মোবিল ধুলো মিশ্রিত নোংরা জল ছিটিয়ে ও আনন্দ পাচ্ছিল। আবার ফোঁকলা দাতে হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমি মুচকে হেসে মাথা দুলিয়ে নোংরা জল ছিটিয়ে না দিতে নিষেধ করলাম। দূর থেকে নিষেধ করলাম। আমার কথা শুনল না। হাসতে হাসতে যেন ‘ঘৃণা ঘৃণা’ মজার খেলা করছিল। এই খেলা জলনুপূরের মজা ওর কাছে! আর আমাদের কাছে? অভিবাসন?
তিন্নি সেদিনের ছোট ছবির মতবিনিময় সভায় আরও বলেন, ‘বলিউড-হলিউড’-এর নায়করা একমাত্র নায়ক কী? ‘মিড নাইট’, ‘কাউ বয়’, ‘বাই সাইকেল থিভস’-এর মতো ছবি আমাদের সামনে আছে। তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবি এবং আর্ট ফিল্ম বা তৃতীয় ধারার ছবির সঙ্গে তুলনায় বর্তমান সময়ে কী ধরণের ছবি হতে পারে?’’
প্রশ্ন তুললেন পরিচালক, গবেষক এবং ছোট ছবির নির্মাতা তিন্নি ভট্টাচার্য। আমরা উত্তর খুঁজি। বাংলাদেশের চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ বলেছেন, ‘’আমরা যত মিশ্র, তত সমৃদ্ধ। এটা মানলেই সমস্যা থাকত না।‘’
No comments:
Post a Comment