দীপেন্দু চৌধুরী
সালটা খুব সম্ভবত ১৯৭৬। আমরা স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি
নিচ্ছি। রাজনৈতিক সচেতনতা মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে ততটা আসার কথা নয়। তবু কিছুটা ছিল।
প্রেক্ষাপট অবশ্যই আমার বাবা, মা, দাদা সহ আমাদের পরিবার। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের
‘কংগ্রেস’ পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্র। এছাড়া ছিল আমার উপর আমার মায়ের ‘স্বদেশী
আন্দোলন’-এর প্রভাব। এই ১৯৭৬ সালে আমার জীবনে তথা আমার সামাজিক জীবনে একটি বড় ঘটনা
ঘটে যায়। সে বছর দুর্গাপূজোর সময় একাদশির দিন ‘শ্যামধারী’ নামে একজন ‘দলিত’
(বর্তমানে বিতর্কিত শব্দ) শ্রেণির মানুষ আমাদের বাড়িতে ‘সিঁদে’ নিতে আসে। গাঁধীজীর
ভাষায় সেই সময় এই সমাজের প্রান্তিক
মানুষদের ‘হরিজন’ বলা হত। অথবা তথাকথিত
সমাজপ্রভুদের কাছে তপসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত যেসব
মানুষরা ‘অচ্ছুৎ’ ছিল। অস্পৃশ্য ছিল। তাঁদের
অবস্থানকে ‘হরিজন’ হিসেবে লেখা হত। পরে হরিজন শব্দটির
ব্যবহারও উঠে যায়। আমাদের প্রসঙ্গ ‘শ্যামধারী’। সে আমাদের ছোট্ট গঞ্জ শহরের
বিভিন্ন পাড়ায় কাঁচা ড্রেন পরিষ্কার করত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ‘বর্জ’, মল,
মূত্র পরিষ্কারের কাজ করতে হত শ্যমধারীকে। যে সব বাড়িতে খাঁটা পায়খানা ছিল সেইসব
বাড়িতেও শ্যামধারী মল, মুত্র পরিষ্কারের কাজ করত। শ্যামধারীদের মত ‘মেথর’, ‘ডোম’
এঁরা একাদশী থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘সিঁদে’ নিতে যেত।
সে বছরও আমাদের বাড়িতে তিনি এলেন। পড়নে ‘মার্কিন
কাপড়’-এর নতুন কোরা ধুতি। লুঙ্গির মতো করে পড়েছেন তিনি। খালি গায়ে একটা নতুন
সস্তার গামছা। খালি পা। হাতে একটা বাঁশের ঝুড়ি। তাতে ‘বাবু বাড়ি’ থেকে যে যা যা
দেবে সে সব শ্যামধারীর ঝুড়িতে ফেলতে হবে। আমার মা-ও দিলেন। সিঁদুর লাগানো সুপারি, চাল, আলু, নারকেল নাড়ু, খইয়ের নাড়ু, চিড়ের নাড়ু।
এবং সিঁদুর লাগানো পাঁচটা টাকা সঙ্গে ধাগা। সুতোর ধাগা সিঁদুর এবং হলুদ জলে চোবানো। শ্যামধারী
দূর থেকে মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমাকেও প্রণাম
করতে এলো। শ্যামধারি আমার থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছরের বড়। আমি থামিয়ে
দিয়ে প্রথমে নমস্কার পরে ‘কোলাকুলি’ করলাম। এবং আবার নমস্কার করলাম। শ্যামধারীর
দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। টপ টপ করে চোখের জল শিশির বিন্দুর মতো আমার পীঠে পড়ল।
শ্যামধারী ওইদিনের পর থেকে আমাদের বাড়িতে আর কোনওদিন ড্রেন পরিষ্কার করতে আসেন নি। ওর ছেলে আসত। পরে আমি ওর সঙ্গে বহুবার কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাকে দেখলেই ছুটে পালিয়ে
যেত। প্রচুর দেশীমদ খেত। চুল্লু খেত। সেই কারণে অনেকেই ওকে এড়িয়ে চলত। আমি
সমাজকর্মী হিসেবে একবার শ্যামধারীর বাড়ি গিয়েছিলাম। হাসপাতালের মেথর বস্তিতে থাকত।
সেই সময়ের এই সব বস্তির যেমন ছবি হয় সেরকমই ছিল। চারিদিকে নোংরা, শুয়োর, মুরগী
ঘুরছে। নাকে পোটা ঝরা ছেলে মেয়ের দল উদোম গায়ে খেলা করছে। কম আলোর খড়ের চাল দেওয়া ঘর। শ্যামধারী ছিল না। ওর বড় ছেলে ছিল। এখন নাম মনে নেই। আমাকে ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের দেওয়ালে দেখলাম
তিনটে ছবি। একটা শিবদুর্গা, একটা কালী আর অন্যটা মহাত্মা গাঁধীর। তিনটে ছবিই
ক্যালেন্ডার কেটে বাঁশের সরু বাতা দিয়ে ঘরে বাঁধানো। মহাত্মা গাঁধীর ছবির নীচে
বাংলায় লেখা ‘সত্যমেব জয়তু’। যদিও শ্যামধারিরা বিহারের লোক। আর্থিকভাবে দুর্বল
পরিবার। প্রান্তিক সমাজের অ-জলচল সম্প্রদায়ের মানুষ ওরা। নিম্নবর্ণের মানুষ। পেটে চুল্লুর জল যতটা
পাওয়া যাবে, তুলনায় পেটে ঘুষি মারলে একটা হিন্দি বা বাংলা শব্দ বেরবে না। তাতে
ওদের কীই বা এসে যেত? তাই ক্যালন্ডারের ছবি বাঁশের সরু বাতা দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে।
মহাত্মাজীকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এর থেকে আর বেশি কী করতে পারে? আমার সেদিন প্রথম ভারতদর্শন
হয়ে যায়। গাঁধীজীর ভারতকে সেদিন প্রথম খুঁজে পাই আমার নিজের শহরে।
সেদিনের পর থেকে দু’টো গানের কয়েকটা কলি আবেগের
সঙ্গে মনে মনে আবৃত্তি করি। একটা ‘ধন
ধান্যে পুস্পে ভরা/ আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে যে এক/ সকল দেশের সেরা।’
দ্বিতীয় গানটা ‘ও আমার দেশের মাটি/ তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। আজও দুটো গান কোনও
শিল্পীর ভরাট গলায় শুনে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারি না। মন খোঁজে গাঁধীজীর গ্রাম।
গাঁধীজির আটচালা, তাঁর সাধের চরকার আশ্রম।
আজকে গাঁধীজীকে নিয়ে আমার সীমাবদ্ধ ঞ্জানে যে
লেখাটা লিখতে চাইছি সঙ্গে এই অভিঞ্জতা না দিলে নিজেকে হয়ত ঠাকানো হবে। এই কারণে
বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে বিনীত অনুরোধ। এই অভিঞ্জতাকে কোনওরূপ আত্মপ্রচার হিসেবে ভাববেন না। গাঁধীজী নিজের আত্মকথায় লিখছেন, ‘’পৃথিবীতে কাহাকেও ঘৃণা করিতে অসমর্থ বলিয়া আমি
নিজেকে মনে করি। বহু কালের প্রার্থনাময় ও সংযত জীবন যাপনের ফলে চল্লিশ বৎসরের বেশি
হইল কাহাকেও ঘৃণা করা হইতে বিরত আছি। আমি জানি যে এই দাবি খুব বড় রকমের, তথাপি
সবিনয়ে আমি এই দাবি করি। কিন্তু যেখানেই পাপ থাকুক আমি তাহা ঘৃণা করিতে পারি এবং
করিও। ইংরেজরা ভারতবর্ষে যে- শাসনপ্রণালী চালাইতেছে তাহা আমি ঘৃণা করি। লক্ষ লক্ষ
হিন্দু যে-কুৎসিত অস্পৃশ্যতা-রীতির জন্য নিজেদের দায়ী করিয়া রাখিয়াছে আমি অন্তরের
অন্তস্থল হইতে তাহা যেমন ঘৃণা করি, ভারতের নির্মম শোষণকেও তেমনি ঘৃণা করি।‘’ (
পৃষ্ঠা- ৪৬, মানুষ আমার ভাই, সাহিত্য অকাদেমী, নিউ দিল্লি, শতবর্ষপূর্তি সংস্করণ,
২ অক্টোবর, ১৯৬৯)
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং গাঁধীজী
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা কংগ্রেস নামক দলের
ইতিহাসে সবচেয় গুরুত্ব দিতে হয় তিনজন প্রথম সারির ব্যক্তিকে। তিনজন ব্যক্তি ছিলেন
মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী, জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু। মা ডাকতেন- মনিয়া।
বাবা বলতেন মনি। সেই মনি বা মনিয়া হয়ে উঠলেন মহাত্মা, বন্দিত হলেন দেশের
পিতা হিসেবে। বর্তমান একুশ শতাব্দীতেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। নিঃসন্দেহে হিংসার
প্রশ্নে তাঁর চিন্তাধারা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। নিম্নবর্ণের মানুষ আক্রান্ত হলেই জেনে হোক অথবা না
জেনে তাঁর চিন্তাধারায় আশ্রয় খোঁজে। ওই অর্ধনগ্ন দেহের একজন মানুষের কাছে ছুটে
ছুটে যায়। আমার এক স্কুলের শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখেছিস কখনো? গাঁধীজী
একজন ব্যারিস্টার মানুষ। যেমন তেমন ব্যারিস্টার নন। বিলেত থেকে পাশ করে আসা
ব্যারিস্টার। সেই মানুষ, হেটো ধুতি পড়ে হাতে একটা লম্বা লাঠি নিয়ে দেশের এপ্রান্ত
থেকে সে প্রান্ত ছুঁটে চলেছেন। কি করে সম্ভব? ভেবে দেখ।’ আমি সত্য সত্য আজও ভাবি।
ভারতের আত্মা চিনে ছিলেন তিনি। আউল, বাউল, ফকির, সুফি, সাধুসন্ন্যাসীদের দেশ
ভারতবর্ষ। তৎকালে দেশের নিম্নবর্ণের মানুষ বছরে একবার অথবা দু’বার জামা পড়তেন।
বাড়িতে কোনও উৎসবে অথবা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে। এই সংস্কৃতি তিনি আত্মস্থ
করেছিলেন। শুধুমাত্র এই একটা কারণই নয়। নিজের লব্ধ ঞ্জানের উপলব্ধি ব্যক্তিত্ব গড়ে
তুলতে সাহায্য করেছিলো বলেই মনে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় তিনি অনুভব করেছিলেন
খেটে খাওয়া মানুষের হ্রদয়ে পৌঁছতে গেলে তাঁদের নিজেদের লোক হতে হবে। তাঁদের কাছে
বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। গাঁধীজীর রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছিল গত শতব্দীর
দ্বিতীয় দশকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সযত্ন লালিত আপন চর্চা তাঁকে
গণদেবতার আসনে বসিয়ে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেক্ষাপটটা কী ছিল? সেই দেশের নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস মূলত সেখানকার ব্যাবসায়ীরা নিজেদের
দাবি সমূহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে পেশ করত। নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের
মাধ্যমে। এই ব্যাসায়ীরা অবশ্যই ছিলেন ভারতীয় এবং বিত্তবান। খেটে খাওয়া
শ্রমিকশ্রেণীর এই সংগঠনের সদস্য হবার অধিকার ছিল না। সেই বিষয়টা গাঁধীজীকে ভাবিয়ে
থাকতে পারে। তিনি ভারতে ফিরলেন এমন একটা সময়ে যখন কংগ্রেসের হাল ধরার মতো কেউ নেই।
যে ব্যক্তি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারবে আবার দেশের স্বাধীনতার
দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে তিনি ভারতে এলেন। আট বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন করে ১৯১৬ সালে
তিনি ভারতে এলেন। ভারতে একদিকে খিলাপৎপন্থীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলছে।
পাশাপাশি কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আওয়াজ উঠছে। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট,
ব্রিটিশপ্রভুর অত্যাচারে জর্জরিত ভারতীয়রা স্বাধীনতার দাবিতে উদ্বেল হয়ে উঠছে।
ভারতের এই গণআন্দোলন গাঁধিজীর জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করেই রেখেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত গণআন্দোলনের
অভিঞ্জতা ভারতের আন্দোলনে কাজে লাগাতে তিনি সচেস্ট হলেন। অভিঞ্জতা থাকলেই
গণআন্দোলনের রাশ ধরা যায় না। প্রয়োজন হয়ে থাকে আরও কয়কটি বিষয়। এর মধ্যে অন্যতম
উল্লেখিত নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির। যেটা গাঁধীজী সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে
তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে দ্রুত জায়গা করে নিলেন। পরিসর আগে থেকে তৈরিই ছিল। সঙ্গে
তিনি যুক্ত করতে পারলেন নিজের সাধারণ অর্ধউলঙ্গ পোশাক, পায়ে খড়ম, আকর্ষনীয় সরল
সাধারণ জীবনযাত্রা। এবং ভারতীয় প্রথম সারির ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণ ঘটাতে
সহায়ক হয়ে উঠলেন তিনি। ধর্ম এবং রাজনীতির এই সমন্বয় তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে
সহজেই গ্রহণ যোগ্য করে তুলল। ভারতের প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবর্ণের মানুষ যাদের
অচ্ছুৎ করে রেখেছিল সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণী। গাঁধীজী তাঁদের
কাছে ‘মিথ’ হয়ে গেলেন। ভারতের নিরন্ন, খেটে খাওয়া মানুষ মোহাবিষ্টের মতো তাঁর গড়ে
তোলা আদর্শ, মঞ্চ, আন্দোলন, চরকা, আশ্রমে ভিড় জমাতে থাকলেন।
বিহারের চম্পারন এবং গুজরাটের খেদায় দীর্ঘদিন থেকে
চলে আসা কৃষক আন্দোলনের পাশে থেকে আন্দোলনের সাফল্য আনতে সাহায্য করলেন। এই দু’টি
ঘটনা তাঁকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করতে সফল হল। পরাধীন ভারত পেল তাঁর নেতা। এরপর আমরা
পেলাম তাঁর সেই বিখ্যাত অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২০-২১ এবং ১৯৩০-৩১ এর আইন অমান্য তথা অসহযোগ
আন্দোলন কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো উথাল পাথাল রূপ নিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বলছেন ‘স্বরাজ’
নামক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের জন্য দেশ প্রস্তুত ছিল না। ভারতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থ
দেখা এবং দেশের ধর্ম-বর্ণ সহ একাধিক সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখাটা প্রকৃত নেতার কাজ
ছিল। সেই কারণে তিনি অনেক সময় দ্বিধায় ছিলেন। আন্দোলনের রাশ যাতে লাগাম ছাড়া না
হয়ে যায় এই বিষয়টা সম্ভবত ব্যক্তি এবং ব্যরিস্টার মোহনদাসকে ভাবতে হয়েছিল। এই
কারণেই কী তিনি ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকে ভারতীয়দের হাতে কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের
পক্ষে ছিলেন? ১৯২১ সালের কংগ্রেস অধিবেশন, ১৯২৭ সালের মাদ্রাজে কংগ্রেসের অধিবেশন
এবং ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনেও তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু এক
বছর পরে তিনি উপলব্ধি করছেন ভারতের গণজাগরণকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। ১৯২৯ সালের
লাহোর অধিবেশনে নিজেই পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ
ভারত ছাড়ো আন্দলনের ডাক দেশের একমাত্র এবং অদ্বিতীয় নেতা মহাত্মা গাঁধী নিজেই
দিচ্ছেন। অনাহার অনশন মানুষের বলে সভ্যতা জেনেছিল। তিনি সেটাকেই হাতিয়ার করে এগিয়ে
আস্তে থাকলেন। অহিংসার সেই মহামন্ত্র বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের
মানুষের আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। সম্প্রতি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক
ওবামা বলেছেন তাঁর আদর্শ হচ্ছেন তিনজন, মহাত্মা গাঁন্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং
মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়ার)। মহাত্মা গাঁধীকে নিয়ে সারা বিশ্বে নতুন করে বিশ্লেষণ
হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে। অবশ্যই নতুন করে মূল্যায়ণ প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ভারতে
গাঁধীজীর মতো গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির আবারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেই কারণে কী
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী মানসরোবর থেকে
ফিরে রাজঘাট গেলেন? কৈলাসে তীর্থ করতে গিয়ে নিয়ে আসা মানসরোবর হ্রদের জল রাজঘাটে
গাঁধীজীর সমাধিতে অর্পণ করেন রাহুল। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কৈলাস যাত্রার পাথর। সেই
পাথরও তিনি গাঁধীজীর সমাধিতে অর্পণ করেন। ভারতীয়দের বিশ্বাস কৈলাস যাত্রার পাথর
কাউকে দেওয়া হলে তাঁরও কৈলাস সফরের সমান পুণ্যলাভ হয়।
বিজেপিও কী অনুভব করছে? কারণ সামনের বছর গাঁধীজীর সার্ধশতবর্ষ
পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে দু’টি সভা হয়ে গেছে। এটাও
চরম সত্য যে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনে গাঁধীজীর অনশন আর গীতা
পাঠের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করেছিলেন। মনুবাহেন গাঁধী জানতে চেয়েছিলেন, এমন দিনে
তিনি উপবাস কেন করছেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন পুণ্যদিনেই মানুষ উপবাস করে। কারণ
তাতে শরীর সুস্থ থাকে। কেউ কেউ উল্লেখ করেন, না সেটা একমাত্র কারণ নয়। খুব সম্ভবত
তিনি নীরবে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশ ভাগ মেনে নিতে পারেননি। মহাত্মা
গাঁধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী নৃবিঞ্জানী নির্মলকুমার বসু খুব কাছ থেকে মহাত্মাকে দেখেছেন।
গাঁন্ধী দর্শনকে উপলব্ধি করেছিলেন। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘’.........১৯৪৭
খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটনা। তখন গান্ধীজী বেলিয়াঘাটায় রহিয়াছেন এবং
স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে বহু বিষয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্কের পর এই আশ্বাস লাভ করিয়াছেন
যে, তাহারা স্থানীয় একটি বস্তি হইতে মুসলমানদের উৎখাত করিয়া দেওয়া সত্বেও এবার
তাহাদের মধ্যে যাহারা পরিশ্রম করিয়া খায় (............) তাহাদিগকে ফিরাইয়া আনিবেন
ও স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে তাহাদের সহিত সুব্যবহার করিবেন। যাহারা গত এক বৎসর
ধরিয়া সর্বতোভাবে পাকিস্তান কায়েম করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদিগকে সদব্যবহারের
দ্বারা আনুগত্যশীল ভারতের নাগরিকে রূপান্তরিত করিবার চেষ্টা করিবেন।
এই প্রতিঞ্জা গান্ধীজী যুবকগণের নিকট ১৫ই অগাস্ট
নাগাদ লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অগাস্টের শেষে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম
সপ্তাহে কলিকাতায় আবার এক দাঙ্গার সূচনা হয় এবং গান্ধীজীর সম্মুখেই বোমার আঘাতে
দুইজন পলায়মান মুসলমান প্রাণ হারায়। গান্ধীজী অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া উঠিলেন।
পাঞ্জাবে তখন বিপুল দাঙ্গা চলিতেছে। আবার কলিকাতার দাঙ্গা যদি পূর্বাঞ্চলে ছড়াইয়া
পড়ে তবে বিপদের অবধি থাকিবে না। সূচনাতেই এই আগুন কি ভাবে নিবানো যায় সে-বিষয়ে
চিন্তা করিতে লাগিলেন।‘’
নির্মলকুমার সেই সময়ের ঘটমান ঘটনার এই বিষয়টি
উল্লেখ করে থেমে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি থামেননি। তিনি ওই একই প্রবন্ধে আরও
লিখছেন, ‘’ইতিমধ্যে বেলিয়াঘাটার যুবকের দল তাঁহার নিকটে এক নিবেদন করিলেন। অবশিষ্ট
মুসলমানদিগকে তাঁহারা স্থানান্তরিত করিতে দিবেন না। তাঁহাদের মধ্যে দুই তিনজন
গান্ধীজীর যুক্তির প্রতি অনাস্থাবশতঃ পলায়মান মুসলমানদের উপরে বোমা নিক্ষেপ
করিয়াছিলেন, কিন্তু অধিকাংশই তাঁহার যুক্তি মানিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহারা অবশিষ্ট
বস্তিবাসীদের রক্ষার ভার লইবার সংকল্প করিয়াছেন। কিন্তু এই কাজ অস্ত্রের দ্বারা
সাধন করিবেন। অহিংসা তাঁহারা জানেন না, বোঝেন না। অতএব তাঁহাদের প্রার্থনা, পুরানো
মিলিটারি বন্দুক সমেত যদি পুলিশ তাহাদিগকে রাত্রে গ্রেপ্তার করে তবে গাধীজী যেন
পুলিশকে বলিয়া তাঁহাদের ছাড়িয়া দেন।
এই বিচিত্র প্রার্থনা যখন গাধীজীর নিকটে পৌঁছাইল,
তিনি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া বলিলেন— ‘এঁদের বলিয়া দাও যে আমি সঙ্গে আছি।’
(উনকো কহ দো কি ম্যায় উনকে সাথ হুঁ)। আশ্চর্য হইয়া পরে যখন তাঁহাকে জিঞ্জাসা
করিলাম, হিংসা বা অহিংসার তাহা হইলে সম্পর্ক কি? তিনি যাহা বলিলেন, তাহার মর্ম
আপনাদের নিকট জানাইয়া আমার এই বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটাইতেছি।
গাধীজী বলিলেন— ‘গভর্ণমেন্ট আজ প্রত্যেক নাগরিকের
জীবন রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় যুবকেরা যে সৎ উদ্দেশ্য লইয়া
হিংসার ব্যবহার করিতেছেন, আমি নৈতিক বিচারে সেই উদ্দেশ্যকে সমর্থন করি। তাঁহারা
অহিংসার কৌশল জানেন না। এ ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব হইল অহিংসার দ্বারা কি ভাবে রক্ষা
সম্পাদন করা যায় তাহাই কার্যতর দেখাইতে হইবে, যতক্ষণ তাহা না পারিব ততক্ষণ
যুবকদিগকে অপেক্ষা করিতে বলিতে পারি না, তাঁহারা স্বীয় ধর্ম অনুসারে আচরণ করিতে
পারেন।’
নির্মলকুমার বসুর লেখা থেকে খুব পরিষ্কার হচ্ছে
গাধীজী ‘স্বদেশ’ বলতে বুঝতেন আর্থসামাজিকভাবে উন্নত একটি রাষ্ট্রে সব ধর্ম, সব
বর্ণ, সব জাতি এক সঙ্গে থাকবেন। সেটাকেই আধুনিক উন্নত গণতন্ত্র বলে। এই শিক্ষা,
সংস্কৃতি তিনি যেমন সনাতন ভারতের গ্রাম সমাজ থেকে পেয়েছেন। পাশাপাশি শিল্প
বিপ্লবের পরে ইউরোপের যে আলো ভারতে এসে আছড়ে পড়েছিল। যেটাকে আমরা উনবিংশ শতাব্দীর
রেঁনেশা বলি। এই সময়ের একটু আগে পরে রাজা রামমোহন রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হেনরি
লুই ডিরোজিও, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একঝাঁক বাঙালি তথা ভারতীয় দেশ গঠনের জন্য কাজ করে
গেছেন। গুজরাটের ছোট্ট মনিয়াও (গাঁধীজীর মা ডাকতেন) একদিন ওইসব মনীষীদের পথ অনুসরণ
করে মহাত্মা হয়ে উঠলেন।
বি কে ভার্মা তাঁর Modern Indian political system: problems and
prospects বইয়ে লিখছেন ‘’.......On the other hand, as differentiated from modern
western political thought, recent western political thought begins with Hegel
and Marx. Roughly the period, is parallel to the period indicated by modern
political thought in India. Rammohan Roy was the contemporary of Hegel; Dayananda was the contemporary of
Marx. In the history of modern Indian political thought a well-defined,
clearcut and precise distinction between recent and modern is not possible.
There is a line of distinction, however, between the exponents of the
renaissance in India and the builders of the theory of nationalism. Roughly we
can say that Rammohan Roy is the key figure in modern Indian political thought.
Mahatma Gandhi has been the greatest personality in the contemporary history of
India. From Gandhi, we can trace the rise of recent political thought. The
recent theorists of Hindu and Muslim communalism may be taken, in some senses, to
belong, intelectually, to the early period of the religious reformation of
India.’’
মুনিয়াকে আমরা মহাত্মা বলে সম্বোধন করতে পারি। কিন্তু এটাও সত্যি তিনিও মানুষ ছিলেন। গাঁধীর মতে
অথবা তাঁর দর্শনে ব্যক্তির ভূমিকা সংগঠনের চেয়েও বড়। গাঁধি কোনও অবস্থাতেই একজন
ব্যক্তিকে তাঁর ভূমিকা থেকে রেহাই দিতে চাননি। একজন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছতে
চেয়েছেন তিনি। একজন ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব হলে তবেই সমষ্টির বিকাশ সম্ভব। আধুনিক
গণতন্ত্রও সম্ভবত সেই আধার খোঁজে। আধুনিক ভারতের আধুনিক সংস্কৃতি, তথ্যপ্রযুক্তি,
সামাজিক ভারসাম্যকে মান্যতা দিতে মুনিয়া বা মহাত্মা গাঁধীকে ভারতের খুব প্রয়োজন।
আমরা অপেক্ষায় আছি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে তাঁর সার্ধশতবর্ষে গাঁধীজীর
আধুনিক মননশীল বিশ্লেষণাত্বক লেখা দেখা এবং পড়ার জন্য। চলতি বছরের ২মে মোহনদাস
গাঁধীর সার্ধ শতবার্ষিক উদযাপনের প্রস্তুতি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদী। বৈঠকটি হয় রাষ্ট্রপতি ভবনে। প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে
প্রধানমন্ত্রী সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের অনেকে উপস্থিত না হলেও
এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের তরফে বৈঠকে
গিয়েছিলেন গুলাম নবি আজাদ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পরে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’গাঁধীর আদর্শকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ে অনেকে আজ
মতামত জানিয়েছেন। আমরা একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি।
পাশাপাশি জানিয়েছি, বছরটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বছর হিসাবে পালন করা হোক।
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নিজেও বলেছেন, গাঁধীজীর আদর্শ বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে
হবে। গাঁধীর আদর্শ প্রচার করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীও।‘’
কংগ্রেস সূত্রে খবর সরকারি উদ্যোগে যেটা করছে
করুক। তবে গাঁধীজী কোনও দলের বা একজন ব্যক্তির নয়। গাঁধীজী জাতির জনক। কংগ্রেস আলাদাভাবে গাঁধী সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচী নিচ্ছে। সম্প্রতি গাঁধী রচনাবলির প্রথম খন্ড
পড়ছিলাম। আধুনিক ভারতের রূপকার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একটি লেখা পড়লাম। ইতিহাস
বলছে পণ্ডিত নেহরু ছিলেন গাঁধীজীর সব থেকে কাছের মানুষ। তাই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ গঠন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে যেমন মতের মিল হয়েছে, সভ্যতার নিয়ম
মেনে মতের অমিলও হয়েছে। তবু গাঁধীজী কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মতিলাল নেহরুর সামনে
ছেলে জওহরলালের নাম প্রস্তাব করেছেন কংগ্রেস অধিবেশনে। ভারত সরকারের তথ্য ও
সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত মহাত্মা গাঁধীর আত্মজীবনীর প্রথম খন্ডে পণ্ডিত
নেহরু লিখছেন, ‘’We shall not think of him as an old man, but rather
as one who represented with the vitality of spring the birth of a new India. To
a younger generation who did not come in personal contact with him, he is a
tradition, and numerous stories are woven round his name and activities. He was
great in his life he is greater since he passed away.’’
‘’……….I write this in
Darjeeling with the mighty Kinchinjunga looking down upon us. This morning I
had a glimpse of Everest. It seemed to me that there was about Gandhiji
something of the calm strength and the timelessness of Everest and
Kinchinjunga.’’
পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাসবিদ, গাঁধী বিশেষঞ্জরা আগামীদিনে ব্যক্তি গাঁধী, পারিবারিক গাঁধী, সামাজিক
গাঁধীর বিভিন্ন দিক উন্মোচন করবেন। সেইসব লেখায় ব্যক্তি গাঁধী এবং মহাত্মা গাঁধীর
দ্বান্দিক বিকাশ, ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে পারিবারিক জীবনের টানাপড়েন আরও বিস্তারিত
সামনে আসবে। কয়েক দশকের তাঁর ব্যপক কর্মকান্ডের কতটা আর আমরা জানি?
No comments:
Post a Comment