Sunday, 25 February 2018

কলকাতায় জাপানীজ ‘চায়ে’পে চর্চা

কলকাতায় জাপানীজ ‘চায়ে’পে চর্চা:  
স্মৃতি আমাকে বা আমাদের জানান দিতে চায়। আমি কোথায় ছিলাম। আমরা কোথায় ছিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে হঠাত করে আমার মনে পড়ছে আমি একদিন ‘চায়ের পাতা’ ২০০, ৩০০, ৫০০ গ্রাম করে ব্রাউন প্যাকেটে ভরে সাত সকালে, মোরগ ডাকা, ঘুঘু ডাকা সকালে বেড়িয়ে পরতাম শীতের কুয়াশা ভেঙে, গ্রীষ্মের তরুণ রোদের উষ্ণতায়, বসন্তের পলাশ ফুলের আমন্ত্রণে। যেন অনেকটা আজ সকালের আমন্ত্রণে। সাইকেলের দু’টো হ্যান্ডেলে ব্যগ ঝুলিয়ে আমি বেড়িয়ে পরতাম। চা বিক্রি করেই নিজের জীবিকা শুরু করেছিলাম। ছাত্র জীবনে। গত চার পাঁচ বছর হল ভারতীয় কথ্য অভিধানে একটা কথা খুব প্রচলিত হয়েছে। ‘চায়ে পে চর্চা’। এনডিএ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে চায়ের পাতা গরম জলে ভিজিয়ে চা তৈরি করতেন। নিজের বাবার চায়ের দোকানে চা বিক্রি করতেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে মানুষের কাছে পোঁছে দিতে বিজেপি নামক দলটি এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায়নি। নরেন্দ্র মোদী চা বিক্রি করতেন এই বাস্তব গল্পকে পরতে পরতে সাজিয়ে বিঞ্জাপনী মোড়কে সাজিয়ে বাজারে চালু হল ‘চায়ে পে চর্চা’।
আমাদের গল্প চা বিক্রির গল্প নয় বা ‘চায়ে পে চর্চা’-র আড়ালে নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা দলকে বাজারজাত করার শব্দ বাক্যের ‘ঢেউ’ এর লোককথা নয়। এই লোককথা আধুনিক কলকাতায় বসে জাপানের লোককথা। ইতিহাস বলছে ‘চা পাতা’ সারা বিশ্বে এসেছে প্রাচীন চিন সভ্যতা থেকে। চিনের চা এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে পৌঁছেছে আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে। দক্ষিণ পশ্চিম এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উল্লেখযোগ্য দেশগুলির মধ্যে জাপান অন্যতম। শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) দক্ষিণ কলকাতার একটি আধুনিক ‘টি পার্লার’-এ চা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এই পর্যন্ত চেনা গল্প মনে হচ্ছিল। উচ্চ শিক্ষিত রঞ্জনা দত্ত নিজের প্রচেষ্টায় ‘টি টাইম স্টোরিজ’ নামে গোলপার্কের কাছে একটি ‘টি পার্লার’ চালচ্ছেন গত বছর দু’য়েক। রঞ্জনা দত্তের আমন্ত্রণে সেদিনের ‘চা উৎসবে’ গিয়েছিলাম। রঞ্জনার ‘টি পার্লার’ –এ ‘মাচা’ (Matcha) ব্রান্ডের চা শনিবার থেকে পাওয়া যাবে। বহুমূল্যের অভিজাত এই চা খোলা বাজারে আদৌ কি পাওয়া যায়?
মাচা চা বাজারে কোথায় পাওয়া যায় সেটা চা বাজার বিশেষঞ্জরা ভালো বলতে পারবেন। আমি সেদিন যেটা জানতে পারলাম জাপান নামক এশিয়ার একটি উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশে ‘চা পাতা’ কে কেন্দ্র করে জাতীয় উৎসব হয়। আমাদের বাঙালিদের যেমন দুর্গা পুজো। জাপানে তেমন চা উৎসব। ওই দিনের ‘টি সেরোমনি’ অনুষ্ঠানে রঞ্জনার পার্লারে দু’জন বিশেষ অতিথি এসেছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের দু’জন সন্ন্যাসী। তাঁদের নাম স্বামী প্রভুদ্ধাত্মান্নদ এবং স্বামী মধুরানন্দ। আরও অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সমবেত কয়েকজন অতিথির সামনে একজন জাপানীজ ভদ্র মহিলা নিষ্ঠাভরে জাপানীজ ধর্মীয় প্রথা মেনে ‘মাচা’ চা তৈরি করলেন
রেইকো(Reiko) নামের অত্যন্ত সুভদ্র এবং উন্নত সাংস্কৃতিক ঘরানার মহিলা জাপানীজ ‘রিচুয়াল’ বা জাপানীজ প্রথায় ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থনা করে নিলেন তারপর রেইকো ‘টি পটে’ গরম জল রেখে সেই পাত্রকে আগে ধর্মীয় রীতি মেনে ‘বোলে’ ঢাললেন। একটি বাঁশের অথবা বেতের ট্রেতে পাঁচ ছটা সেরামিক বোল। সঙ্গে একটি করে বাঁশের কাঠের চামচ। ছোট একটি ‘টি পট’ থেকে একটি কাঠের চামচে করে পরিমাণ মত চা নিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বোলের গরম জলে মূল্যবান সবুজ চায়ের গুড়ো পাতা দিয়ে চায়ের ঘন মিশ্রণ তৈরি করলেন ভদ্র মহিলা এতটাই একাগ্রতা দিয়ে করলেন যেন মনে হচ্ছিল কোনও বৌদ্ধ মন্দিরে উপাসনা করছেন। পুরো সময়টা বজ্রাসনে বসে নিষ্ঠার সঙ্গে চা তৈরি করলেন। আমাদের প্রতেক অতিথির হাতে চায়ের বোল তুলে দেওয়ার পর প্রত্যেককে ‘বাও’ করলেন। আমাদের দেশে ঈশ্বরকে ‘নৈবেদ্য’ দেওয়ার পর যেমন আমরা প্রণাম করি। জাপানীজদের কাছে ‘অতিথি’ হচ্ছেন দেবতাসম। তাই অতিথির সামনে নতমস্তকে প্রণাম করতে হয়। এটাই জাপানীজ সংস্কৃতির অন্যতম আচার। পাশাপাশি অতিথিকেও বাও করতে হয়। গৃহস্বামী এবং অতিথি উভয়পক্ষকে প্রথা মানতে হয়। তাইতে আমরাও ‘চায়ের বোল’ নেওয়ার পরে ‘বাও’ করলাম।
জানতে পারলাম জাপানে পরম্পরা মেনে প্রতিটি পরিবার পরের প্রজন্মকে ‘চা উৎসব’ এর নিয়ম শিখিয়ে যান। পরের প্রজন্ম সেই নিষ্ঠা মেনেই বাড়িতে ‘চা উৎসব’–এর আয়োজন করে। এইসব থেকেই মানুষ শিখে যায় ‘মাচা টি’ এবং ‘গ্রীন টি’এর ভেষজ উপকারিতা। শুধু চা হিসাবে নেশা করার ব্যাপার নয়। শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে ওইসব চায়ের উপভোগ বা উপযোগিতায়। শৈশব গ্রীষ্মের উত্তাপ ততটা না থাকলেও রঞ্জনার ‘টি পার্লার’-এর ঘরে এসি মেশিন চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের দেওয়ালে দু’তিনটে তৈলচিত্র। একটার ছবি ভগবান বুদ্ধ চা পান করছেন। আরও দু’টি বুদ্ধদেবের ছবি রয়েছে। এই ঘরটির নাম রঞ্জনা রেখেছেন ‘বুদ্ধারুম’। অনুষ্ঠানে কেন এসেছেন এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী প্রবুদ্ধাত্মানন্দ বললেন, ‘’জাপান চা উৎসব নিয়ে রেইকো কলকাতায় আছেন। ওনার স্বামী বিদেশে থাকেন। ওনারা দুজনেই আমাদের মিশনের সঙ্গে যুক্ত। চা উৎসব জাপানে বিরাট উৎসব। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ভালো লাগছে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে আমরা এসেছি। ভদ্রমহিলার প্রত্যেকটা কাজ মনযোগ দিয়ে করলেন। এরকম আগে দেখার সুযোগ হয়নি। প্রত্যেকটা কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে হয় এটা আমরা শিখলাম। চা তৈরির মাধ্যমেও শৃঙ্খলা কি করে শিখতে হয় আজ দেখলাম।‘’
রঞ্জনা শুধুমাত্র ‘টি পার্লার চালাচ্ছেন তাই নয়। চা বিষয়ক একটি ইন্সটিটিউট চালাচ্ছেন গত ১৮ বছর। প্রেস বিবৃতিতে লেখা আছে, Beside the Tea Management course. Tea Tasting is also separately taught for Tea professional who are either tea executives or Business person. Students come from all over India and abroad from  the entire globe. Tea Management students are given 1 month Industrial Residential Training at various Tea Estates of Assam, Dooars, Terai, Arunachal Pradesh. Note: Course fees of Tea management are also payable in installments.    
পরে রঞ্জনা নিজের অভিঞ্জতা জানালেন একান্ত সাক্ষাৎকারে।
তিনি বললেন, ‘’আমি ছাত্র জীবন থেকেই চায়ের পার্লার খুলতে চেয়েছিলাম। চায়ের সঙ্গে আড্ডা জড়িয়ে আছে। কলোনিয়াল ব্রিটিশদের মতো। সেই জন্য আমি এই নাম দিয়েছি। আমরা বাঙালিরাও আড্ডাপ্রিয়। মাচা টি একবার যে খাবে সে পরেও আবার খাবে। ক্রীম দিয়ে, চকলেট, ক্যাডবেরি সহযোগে মাচা টি খাওয়া যায়। আরও সুস্বাদু করার জন্য। আমাদের যে ইন্সটিটিউট আছে সেই ইন্সটিটিউটের আমি প্রিন্সিপাল। আমাদের এই ইন্সটিটিউট থেকে চা বাগানের মালিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। যে ধরণের পরামর্শ প্রয়োজন। এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে হয়।‘’  

রঞ্জনা আরও জানালেন, তাঁদের গোলপার্কের 'মৌচাক'- এর কাছে পার্লারে (Dipras Institute of Proffesional Studeoes, 178 A Kakulia Road, Kolkata-700029, Tel: 033-65458717, Cell: 9830044806,) চা ছাড়াও কন্টিনেন্টাল ডিশ পাওয়া যায়। এক বছরের স্নাতকোত্তর (পোস্ট গ্র্যাজুয়েট) ‘টি ম্যনেজমেন্ট’ কোর্সের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারে। আবার চা রসিকরাও ভালো চা খাওয়ার জন্য এই ঠিকানায় আসতে পারেন।                                                          


                                                    

1 comment:

  1. Good to have a translated version and an audio file options.

    ReplyDelete