রঙ ফাগুয়ার বিষ্ণুপুরে বসন্তের
রাগ রাগিণীর ডাক:
রাঢ় বাংলার আকাশ
দেখে যারা বড় হয়েছে তারাই বলতে পারে, ‘বসন্ত দীর্ঘজীবি হোক’। অশোক, শিমূল, পলাশের
তাজা রঙ, মহুল ফুলের শান্ত স্নিগ্ধ মৌতাত, সোনালী রঙের তরুণ তাজা রোদ, মেখলা পড়া
আচ্ছন্ন নীল সাদা মেঘেদের চুপি চুপি গুঞ্জন। লাল মোড়ামের ধূলো উড়ি লাল রাস্তায়,
আদিবাসীদের ‘রাঢ় বাংলা’-র মাদলের তালে তালে, চেনা অচেনা সুরে কেউ বলে উঠে আজ
বসন্ত। কিন্তু এই বছর নতুন ভাষায় জানলাম ‘টেরাকোটা শহরে ধ্রুপদী বসন্ত’। ‘ফাগুন
হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’। যত সময় যায় চুলের রঙ কালো থেকে সাদা হয়। চকচকে চামড়ার
স্পর্ধা কমতে থাকে। মুখের বলিরেখা জানান দেয় অস্তমিত সূর্যের আলোকপ্রভা ম্লান
হচ্ছে। স্মৃতি মন্থর হতে থাকে।
‘আমন্ত্রণ’ নামক
শব্দের পরিচিতি আমার অভিধানে নেই বললেই চলে। কিন্তু এটাই শেষ বাক্যবন্ধ হলে মানব
সভ্যতা থমকে যাবে। ‘তোমার আপন হারা প্রাণ......’। ‘আহা আজই এই বসন্তে কত পাখি গায়/
কত ফুল ফোটে’।
‘ফাগুন হাওয়ায়
হাওয়ায় করেছি যে দান’। আন্তরিক আমন্ত্রণের কোনও ঘনঘটা ছিল না। অপ্রত্যশিত এক
অভিজাত দাবি ছিল। ‘বিষ্ণুপুর বসন্ত
যাপন সমিতি’-র কার্যকরী সভাপতি তথা স্থানীয় বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের।
আমাকে যেতে হবে এবং বিষ্ণুপুর নিয়ে লিখতে হবে। যদি এখান থেকে শুরু করি তুষারদা কি
আমাকে অমনোযোগী বলবেন? কেন বলবেন? লেখার কোনও কি ধারা উপধারা হয়? সৃষ্টির কি কোনও
বন্ধন থাকে? প্রাণচঞ্চল শৈশব- কৈশোরের যে বাঁকা ঠোঁটের কলকাকলি শুনেছি সেই
অ-আকাঙ্খিত প্রাপ্তির ছবি আমি কোন ভাষায় কোন লিপিতে একে দেখাব? টেরাকোটা শহরের
টেরাকোটা শিল্প, পোড়ামাটির কুশলী প্রশিক্ষণ আমার নেই। আমার হ্রদয়ে যে ছবি এসে বাসা
বাঁধল সেই ছবি আমি পেলাম বিষ্ণুপুর ‘যদুভট্ট মঞ্চে’। ‘বসন্ত যাপন সমিতি’-র গোধূলি বেলার সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানে। দু’জন শিল্পী ক্যানভাসে ছবি আঁকলেন। ‘আজই দখিন দুয়ার খোলা.../ এসো হে
এসো হে এসো হে/ আমার বসন্ত এসো’। বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। দু’টি পাখি দু’টি দিকে
উন্মুক্ত আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বলছে ‘টেরাকোটা শহরে ধ্রুপদী বসন্ত’।
শিল্পীর তুলিতে
ক্যানভাসে আমরা পেলাম নতুন বসন্তের কলকাকলি। পেছনের ‘ডায়াসে’ বেহালার ছড় আমাদের
বসন্তকথা শোনাচ্ছে। সঙ্গে রবি ঠাকুরের লেখা থেকে দু’ই বাচিক শিল্পীর ‘বসন্ত কথা
উচ্চারণ’। এই সপ্তম সুরের প্রথম বন্দনা আমরা পাই সকাল সাতটার প্রভাতি অনুষ্ঠানে।
সাঁওতালি মাদল, আদিবাসী মেয়েদের কলস মাথায় নৃত্য। সবুজ, লাল হলুদ আবিরের রঙ
ফাগুনের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলিত শহর পরিক্রমা। বাংলার ঢোলক, খঞ্জনী আর রবীন্দ্র
গানের আহ্বান, ‘ওগো পুরোবাসি খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগলো
যে দোল/ দ্বার খোল, খোল দ্বার খোল’। সোনালী
শাড়ি, হলুদ পাঞ্জাবী ছিল সোনালী রোদের সহযাত্রী। সকালের বিষ্ণুপুর আপনহারা প্রাণের
টানে দ্বার খুলে বেড়িয়ে এসেছে। প্রাণের মেলায়। বাঙালির আরও একটি বিশ্বজনীন
সংস্কৃতির টানে। রাধাকৃষ্ণের ফাগ ফাগুয়ার বসন্তের ডাকে। বাঁকুড়া জেলার মহকুমা
শহরের ৪৬ টা সংস্থা ১৪২৪ সালের দোল উৎসবে অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ,
সঙ্গীতের স্কুল, নাচের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই রাস উৎসবে অংশ নেয়। অনুষ্ঠানসূচী
অনুযায়ী সমাবেশ হয় মদনমোহন মন্দিরের বাইরে। সকাল ৭টায়। ফুলের পাঁপড়ি, আবির দিয়ে
মন্দিরের বিগ্রহকে পূজো দেওয়া হয়। আনুস্থানিকভাবে শঙ্খ এবং কাঁসর ঘণ্টায় গ্রাম
সভ্যতার ঐতিহ্যের সংলাপ আমরা শুনি। শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে। শেষ হয় ‘চিলড্রেন্স
পার্ক’-এ। দশ বছরের এক কিশোরী সোনালী শাড়ি পড়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা, চুলে বেল
ফুলের মালা গাঁথা। পায়ে ঘুঙ্গুর। ক্লান্তিহীন চোখে আমায় বলল, ‘জেঠু ওদের বল না।
সামনের বছর আমরা সবাই বাড়ির ছাদ থেকে ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে দেব। আবির ছড়িয়ে দেব।
আমাদের মায়েরা শাখ বাজাবে।’ আপনহারা প্রাণ আমার আন্দোলিত হয়ে উঠল, আমি বললাম,
‘হ্যা বলব’। আমার চোখে অদৃশ্য অশ্রু। সকালের সূর্য একটু একটু করে জানান দিচ্ছে
আগামীর পথের আলো খুঁজে নাও।
আমি নিজেও আপ্লুত
হয়ে গানফাগুনের ‘যদু ভট্ট’-র শহরে গলা মেলাতে মেলাতে পুরনো বিষ্ণুপুরে চলে
গিয়েছিলাম। এই লেখায় একটি বিষয়কে নিয়ে চর্চা করব আমরা। কারণ টেরাকোটার শহর। যদুভট্টের
শহর। বিষ্ণুপুর তথা মল্লরাজত্বের চিরন্তন সংস্কৃতির সঙ্গীত ঘরানাকে আপামর মানুষের
হ্রদয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ। তথ্য বলছে দ্বিতীয় মল্লরাজ
রঘুনাথ সিংহ সঙ্গীতাচার্য তান সেনের বংশধর বাহাদুর সেনকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসেন।
বাহাদুর শাহের কাছে গান এবং সঙ্গীতযন্ত্রের প্রশিক্ষণ হয় মহান সঙ্গীত সাধকের।
এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত সাধক ছিলেন গদাধর চক্রবর্তী, রামশঙ্কর ভট্টাচার্য,
অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়,
রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, ঞ্জানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী এবং যদুভট্টের মত সাধকের
জন্ম এই বিষ্ণুপুরে। যে তথ্য এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে সেই তথ্য আমার ব্যক্তিগত
গবেষণার নয়। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি এই তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাই
ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটা আছে সেটা আমি বলতে পারব না। ধ্রুপদী সঙ্গীতের শহর এই বিষ্ণুপুর। সংস্কৃতির বিভিন্ন বাখ্যা বিভিন্ন গুণীজনেরা দিয়েছেন। এবং এখনও দিচ্ছেন।
সংস্কৃতি বলতে বোঝায় অনুশীলনের মাধ্যমে লব্ধ বিদ্যা, চর্চিত রীতিনীতির উৎকর্ষ।
যেটা যে কোনও সভ্যতার উৎকর্ষের পরিচয়। একটি সভ্যতার সংস্কৃতির সূচক কাকে বলব আমরা?
চিত্রকলা, নৃত্য, সঙ্গীত, সাজসজ্জা, গৃহ, সভাঘরের অলঙ্করণ, আহার্য, পানীয় আরও অনেক
কিছু। জানলে আশ্চর্য লাগে বিষ্ণুপুরে
রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় নামে একটি কলেজ আছে। স্থানীয় নাগরিক সমাজের দাবি
ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানা সহ ভারতীয় হিন্দুস্থানী ঘরানার একটি সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ের। ‘টেরাকোটা
শহরে ধ্রুপদী বসন্ত’ (১৪২৪)-এর সাংস্কৃতিক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে ‘যদুভট্ট মঞ্চ’-এ
বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন। তিনি
প্রস্তাব গ্রহণ করে বললেন, ‘’আমি ইতিমধ্যে এই প্রস্তাব লিখিত আকারে শিক্ষা দপ্তরের
উর্ধতন কতৃপক্ষকে পাঠিয়ে দিয়েছি। যদি আমাদের এই প্রস্তাব মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তথা রাজ্য সরকার
অনুমোদন করে, তবে বলব এই সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিক রামশরণ সঙ্গীত
মহাবিদ্যালয়।‘’
বিধায়ক তথা ‘বসন্ত
যাপন সমিতি’-এর কার্যকরী সভাপতি তুষারকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘’আমরা এই অনুষ্ঠান
করছি গত দু’বছর হল। বিষ্ণুপুরের চিরায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ ‘টেরাকোটা শহরে ধ্রুপদী
বসন্ত’। বিষ্ণুপুরের লোকায়ত শিল্পের বিভিন্ন ধারা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম রাধাকৃষ্ণের রাসউৎসব। মল্লরাজারা এটাকে সঙ্গীতের
মূর্ছনায় নগরবাসীর বাৎসরিক উৎসবে পরিণত করেছিলেন। আমরা সেই স্মৃতিকে মনে রেখে
‘দোলের দিন’ এই ধ্রুপদী উৎসবকে বেছে নিয়েছি। শুধু রঙ খেলা নয়। বাঙালির চিরন্তন
সংস্কৃতি ‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’ অনুভব থেকে আগামী দিনে এই উৎসবকে আরও
আকর্ষণীয় করে তুলব। এমন পরিকল্পনা আমাদের আছে।‘’
সাংসদ সৌমিত্র খান
বলেন, ‘’এই নতুন উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। আগামীদিনে এই উৎসবকে আরও রঙ্গীন করতে
আমরা অন্যন্য ভাবনা চিন্তা করছি।‘’
‘বসন্ত যাপন
সমিতি’-এর অন্যতম সদস্য (জনসংযোগ) এবং সমাজসেবী পার্থসারথী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি
নিজে আইনজীবী। কলকাতার আলিপুর জর্জকোর্টের কাজ সামলে এই অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ
দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পার্থসারথীবাবু বলেন, ‘’গত দু’বছর ধরে
বিষ্ণুপুর ঘরানার বসন্ত উৎসব আমরা করছি। নতুন অভিঞ্জতা হচ্ছে। জাতি ধর্মের উর্ধে
সমস্ত স্তরের মানুষ আমাদের এই প্রভাতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। বসন্তের আহ্বানে
আমরা পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করি। বিষ্ণুপুরের রাস উৎসবের এই অনুষ্ঠান আমাদের
কাছে বাঙালির শারদ উৎসবের মত।‘’
পার্থবাবু আরও বলেন
‘’আমরা বিষ্ণুপুর শহরকে অশোক, পলাশ, মহুল গাছে ভরিয়ে তুলব। ইতিমধ্যে এই কাজ শুরু
হয়ে গেছে। বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য এবং সাংসদ সৌমিত্র খান দু’জনেই অত্যন্ত
আন্তরিকভাবে গাছের চারার জন্য জেলা বনদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। টেরাকোটা
শহরে ভবিষ্যতে পর্যটকরা যখন আসবেন শুধু ছায়াশীতল শহর নয়। বসন্তের মরশুমি ফুলের
পাঁপড়িতে স্নান করবেন।‘’
বিষ্ণুপুর ঘরানায় আরও একাধিক বিষয় রয়েছে। যারমধ্যে অন্যতম প্রাচীন
‘শিল্প-বাণিজ্য’। এবং ‘হেরিটেজ শহর’-এর দাবি। আমরা পরের লেখায় এই দু’টি বিষয়কে ধরে
এগবো। আজ আমার উপলব্ধি রাঙা ফুলের রঙ ফাগুয়ার ধ্রুপদী বসন্তের আবির মেখে/ যতন ভাঙা
যতন রাঙা/ বিষ্ণুপুরের পলাশ রঙে, /ফিরে এলাম শহর কলকাতায়/ নাগরিক
আমন্ত্রণে।‘’
No comments:
Post a Comment