বিধানতান্ত্রিক কৈফিয়েত এবং উকিলসভার ভূমিকা:
সম্প্রতি ভারতে বিচার ব্যবস্থার আরও গণতান্ত্রিক করণের আওয়াজ উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চারজন বরিষ্ঠ বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট সহ ভারতের বিভিন্ন আদালতে বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ যে অদৃশ্য অচলয়াতন রয়েছে সেই বিষয়টি আমাদের সামনে আনতে চেয়েছেন। যদিও প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের হস্তক্ষেপ, অন্যান্য বরিষ্ঠ বিচারপতিদের আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং নামজাদা বরিষ্ঠ আইনজীবীদের মধ্যস্থতায় এই বিতর্কের সাময়িক অবসান হয়েছে। কিন্তু বিতর্কের অবসান হয়েছে বলে এক কথায় এই বিষয়ে পরিচ্ছেদ বন্ধ করা যাবে না।
‘পিপলস ল’ইয়ারস’ এবং ‘স্বরাজ অভিযান’ পশ্চিমবঙ্গ শাখার যৌথ উদ্যোগে কলকাতা হাইকোর্টে ১৭ ফেব্রুয়ারি আইন বিষয়ে একটি ‘কনক্লেভ’ হয়ে গেল। আইন বিষয়ক আলোচনাসভার শিরোনাম ছিল, ‘Conclave on Judicial Accountablity & the Bar’। অনুষ্ঠানে বক্তা ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী তথা মানবাধিকার কর্মী প্রশান্ত ভূষণ এবং আইনজীবী অরুনাভ ঘোষ। দু’জনেই ভারতের সাধারন মানুষের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করছেন। এবং তাঁদের আইনি অধিকারের জন্য দেশের মানুষের কাছে দু’জনেই মানবিক মুখ। ওই দিনের আলোচনাসভায় আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। কলকাতা হাইকোর্টের তরুণ বিচারপতিরা মতবিনিময় আলোচনাসভায় চোখে পড়ার মত ভিড় জমিয়েছিলেন। আলোচনায় অংশও নিয়েছেন আইন বিষয়ক গাম্ভীর্যে। আমি এদিনের আলোচনায় শ্রোতা হিসাবে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। কিন্তু এই বিষয়ে কিছু লেখাটা আমার কাছে বাতুলতা হয়ে যায়। অতীত অভিঞ্জতা রয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট সহ একাধিক আদালতে বিভিন্ন খবর করার। সাধারণ ওই পুঁজির অভিঞ্জতা নিয়ে এই বিষয়ে লেখা যায় না। মহামান্য আদলতের প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা নিয়েই এই লেখা একটি রিপোর্টাজ জাতীয় লেখা লিখতে চাইছি। কোথাও বাকচাতুরি বা অতিরঞ্জিত মনে হলে মার্জনা করবেন।
গত শনিবার কলকাতা হাইকোর্টের দোতলায় বার অ্যাসোসিয়েশনের দু’নম্বর ঘরে আলোচনার সূত্রধরের কাজটা করেছিলেন কলকাতা শহরের নামজাদা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তিনি প্রথমেই দাবি করেন ভারতীয় আইন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। অরুণাভবাবু বলেন, ‘’ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি ফোরামের দায়িত্ব রয়েছে সেই ফোরামের উচ্চতম কমিটিকে রিপোর্ট করার ব্যতিক্রম বিচার বিভাগ।‘’
কলকাতা হাইকোর্টে বার অ্যাসোসিয়েশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচদিনের কর্ম বিরতি পালন করবে। মামলার পাহাড় জমে রয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ এনে পাঁচ দিন কর্ম বিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকোর্টের আইনজীবীদের তিনটি সংগঠন। বার অ্যাসোসিয়েশন ছাড়া অন্য দু’টি সংগঠন হল, ‘বার লাইব্রেরি ক্লাব’ এবং ‘ইনকর্পোরেটেড ল সোসাইটি’ নামে আইনজীবীদের অন্য ধারার দুটি সংগঠন। সূত্রের খবর কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি থাকার কথা ৭২ জন। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে ছিল ৩২ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনজন কমে হয়েছে মাত্র ২৯ জন বিচারপতি। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টে ১৫ জনেরও বেশি বিচারপতি অবসর নিয়েছেন। ন্যাশন্যাল জুডিশিয়াল কমিশন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলায় কেন্দ্র হেরে গিয়েছে। এই রায়ের পরে কেন্দ্র নীতিগতভাবে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের উপরেই ছেড়ে দিতে চায়। সংবাদ সংস্থার খবর এমনটাই। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে অরুণাভবাবু বললেন, ‘’কলকাতা হাইকোর্টে ৪৩টা বিচারপতির পদ খালি আছে। এই পদে বিচারপতি নিয়োগের দাবিতে আমরা তিনদিন অবস্থান বিক্ষোভ করেছি। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর পর রয়েছে পাঁচ দিনের কর্ম বিরতি। তৃণমূল কংগ্রেসের মাত্র আটজন আইনজীবী অবস্থান-বিক্ষোভ মঞ্চে ছিলেন। তাঁরা কর্মবিরতি সমর্থন করছে না। আমরা তিনটে সংগঠনের আড়াইশো আইনজীবী অবস্থান-বিক্ষোভে ছিলাম। পাঁচ দিন কর্ম বিরতির পর কেন্দ্র কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখে আমরা আরও বৃহত্তর আন্দোলনে যাব।‘’
তিনি আরও বলেন, ‘’আলোচনাসভার মঞ্চে যে দাবি করেছি আপনাকেও বলছি ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা আনার দায়িত্ব উভয় পক্ষের। আইনজীবীদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে পাশাপাশি বিচারক বিচারপতিদেরও সেই দায়িত্ব রয়েছে। তবেই বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারবে।‘’
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বামপন্থী হিসেবে পরিচিত মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র। তিনি বলেন, ‘’বিচার বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে ন্যায় বিচার দেওয়ার। সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে গরিব মানুষের প্রতিটি অভিযোগ বিচারপতিদের শুনতে হবে।‘’
আলোচনার মঞ্চে ছিলেন কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিঞ্জানের শিক্ষক সঞ্জীব মুখার্জী। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টা উল্লেখ করে বলেন, ‘’আপনারা দেখুন ছত্তিসগঢ়, জম্ম-কাশ্মীর, উত্তর পূর্ব ভারতে কিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। আমরা কিছু ঘটনা জানতে পারি। কিছু জানতে পারি না। ওইসব রাজ্যের আক্রান্ত মানুষ কতটা সুবিচার পায়?’’
শনিবারের আলোচনাসভায় আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ অত্যন্ত গুরুত্ব নিয়ে উল্লেখ করেন যে আমাদের দেশের আশি শতাংশ মানুষ আইনি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। সাধারণ মানুষের জন্য আদালতের ক্ষেত্রে ইনফর্মাল আইন প্রয়োজন। আমরা আইনজীবীরাও সব আইন বুঝি না। সাধারন মানুষ কি করে বুঝবে? ভারতীয় নাগরিককে সংবিধান মোতাবেক আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আসতে হবে। একুশ শতাব্দীতে এই নিয়মের কতটা প্রয়োজন রয়েছে?’’
তিনি আরও বলেন, ‘’আমি ২০টা মামলা জানি। একজন দায়িত্বশীল এবং আইনের প্রতি দায়বদ্ধ একজন বিচারপতি মাত্র ১৫-২০ মিনিট প্রতিটি মামলায় সময় নিয়ে মামলাগুলি নিস্পত্তি করেছেন। সরকার এই বিষয়টা নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। লোকপাল আদালত হলেও এইভাবে বিচার করা আরও বেশি সম্ভব।‘’
প্রশান্ত ভূষণ আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছেন, ‘রিপাবলিকান কন্সটিটিউশন’ মানে মানুষের মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি। প্রত্যেকটি অধিকারের কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিচার বিভাগকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রত্যেক থানাকে এফ আই আর নিতে হবে। আধিকারিকদের আইনের মধ্যেই দায়িত্ব নিতে হবে। কয়েকমাস আগে সুপ্রিম কোর্টের চারজন বিচারপতি যে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন এটা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে কাম্য ছিল না। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা স্বাস্থকর আমাদের ভেবে দেখতে হবে। মানুষের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন, সৎ, স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা। বিচার বিভাগের স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষেত্রে বিষয়টার সঙ্গে ‘জুডিশিয়াল অ্যাকাউন্টিবিলিটি’-র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটা না হলে গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর বিষয় হবে। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
গত বছর একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেছিলেন ‘আজকের দিনটি কালো দিন’। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বরের এ এন আইয়ের করা একটি খবর উধৃত করে ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ১৮ নভেম্বর অন লাইন সংস্করণে
'Black day' in Supreme Court history: Lawyer Prashant Bhushan explains court ordeal শিরোনামে লিখছে,
‘’Petitioner and Supreme Court lawyer Prashant Bhushan, who had sought an SIT Investigation in the medical college bribery scam, termed the Chief Justice of India (CJI), Justice Dipak Misra, overriding J Chelameshwar's order as a 'black day' in the history of the Supreme Court.
"I feel that the behavior of the CJI and the bench was not proper. We haven’t yet seen the order of the court. We’ll first see and then take the call on our future course of action," Bhushan told ANI.
"But this is certainly a black day in the history of the Supreme Court," he added.
The above-mentioned matter pertains to a medical college bribery scam against IM Quddusi (retired Orissa High Court judge) who was arrested among others, by the Central Bureau of Investigation (CBI) under the Prevention of Corruption Act.
On Thursday, a Supreme Court bench, consisting of Justices J Chelameshwar and Abdul Nazeer, referred the PIL, in the matter, to a five-judge bench, scheduled to conduct a hearing on Monday.
However, the case took an interesting turn today, when another Supreme Court bench comprising the current CJI, Dipak Misra, pronounced the order by Justice J Chelameswar null and void.
Bhushan, earlier in the day, tweeted that CJI Dipak Misra presided over a "hand-picked bench to override yesterday's order" by another top court bench.
Speaking to ANI, Bhushan went on to explain the ordeal of the day's proceedings.
"It was one of the most unfortunate days for the Supreme Court and the judiciary, where the credibility of the court has been greatly undermined and that too effectively by the CJI himself. The petition was seeking an independent SIT investigation into a CBI FIR effectively registered against the judges of SC, including the CJI, particularly the CJI. We were asking for an independent SIT investigation and that it should not be left with the CBI, which is a caged parrot under the Central Government," Bhushan said’’ .
দেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য আইনি পরিষেবার কথা বলছেন খ্যাতনামা আইনজীবী প্রসান্ত ভূষণ। আমরা মনে করতে পারি সুপ্রিম কোর্টের একটি ছোট্ট মানবিক নির্দেশনামা। ২০১১ সালের মে মা মাসে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় অনাহারে মৃত্যু রোধ করতে আমাদের দেশের ১৫০টি দরিদ্রতম জেলায় অতিরিক্ত ৫০লক্ষ টন খাদ্য বন্টন করতে হবে।
আইনজীবীদের বিবেক কথা না বললে দেশের বিবেক থমকে থাকে। একটা কথা রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বলে থাকেন ‘আইন আইনের পথে চলবে’। কিন্তু আইন বিভাগের সঙ্গে আইন রচয়িতাদের এবং শাসন বিভাগের একটা চুলচেরা পার্থক্য দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকেই ভারতে পরিলক্ষিত হয়। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে অকথিত এবং অলিখিত একটা সমঝোতার কথাও শোনা যায়। তবুও বলতে হবে আইনজীবীদের বিবেক না থাকলে দেশের বিবেকের চিরন্তন বাক্য ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ আমাদের চিরকাল উচ্চারন করে যেতে হবে। এশিয়ার অন্যতম এক দলীয় গণ প্রজাতান্ত্রিক দেশের আইন রচয়িতারা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশকে আরও উন্নত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। চিন যদি ভাবতে পারে আমরা পারব না কেন?
জিনহুয়া শিরোনামে লিখছে,
Legislators review draft decision on law on private education
BEIJING, Nov. 1 (Xinhua) – ‘’Legislators discussed a draft decision on amending the law on private education Tuesday.
A draft amendment to the law is up for a third reading at the ongoing session of the National People's Congress (NPC) Standing Committee, which proposes banning for-profit private schools from engaging in the 9-year compulsory education that covers the primary and junior high school phases.
The proposal is consistent with a stipulation in the Law on Compulsory Education, which says compulsory education is a free, charitable cause with national financial support, said legislator Wu Heng at Tuesday's panel discussion.
The compulsory education is a legal obligation of governments at various levels, said law professor Feng Liucai, who is also deputy head of Taizhou municipal education bureau in Jiangsu Province, in an interview.
If the law is revised, some for-profit private schools may choose to become non-profit, which means they will no longer charge the students and have their revenue reduced, according to legislator Wang Gang. The government should help and support them during their transformation, Wang said at the panel discussion.
Legislators agreed that the new draft defines clearly for-profit and non-profit private schools and specifies different supportive measures for them, which is expected to promote the healthy development of the private education cause.
They agreed that the draft is feasible and "mature," suggesting it be passed at the ongoing NPC session. Sources: Xinhua’’
‘’রোসালি টারগনস্কি সম্পাদিত ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রূপরেখা’ বইয়ে মার্কিন আইন সম্পর্কে লেখা রয়েছে, ‘’বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষার লক্ষে সংবিধান একটি রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করেছে। সেটি হলঃ ‘সদাচরণ করলে’ যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারকরা মৃত্যু, অবসর গ্রহণ বা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত পদে থাকতে পারবেন। তবে কোনও বিচারপতি পদে থাকাকালীন কোনও অন্যায় কাজ করলে প্রেসিডেন্ট বা অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও নিন্দা প্রস্তাব আনা যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকদের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন, এবং সেনেট কতৃক সেই নিয়োগ অনুমোদিত হয়। তাঁদের বেতনক্রমও কংগ্রেসই নির্ধারণ করে।‘’ পৃষ্ঠাঃ ৮০/৮১
No comments:
Post a Comment