‘পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’, কলকাতা
চ্যাপ্টারের উদ্যোগে রোটারিসদনে একটি অনুষ্ঠান দেখে ফিরছিলাম। দিনটা ছিল ১৩
ডিসেম্বর। শীতের বিকেলবেলা। ক্লান্ত সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আমি ‘বাবু
কলকাতা’-এর ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। আমারতো কোনদিনওদিন বন্ধন ছিল না। সম্ভবত আজও নেই।
শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসের চরিত্রের মতো। পরে ঋত্বিক ঘটক
সিনেমাও করেছেন। সেদিন আমি ব্যস্ততার সঙ্গেই হাঁটছিলাম। ‘বাবু কলকাতা’-এর ফুটপাথ
বরাবর। পাশে ‘সেন্টপলস চার্চ’। পরে বিড়লা প্ল্যাটিনাম। হঠাৎ একটি বার তেরো বছরের
ছেলে আমাকে জিগ্যেস করল, ‘রবীন্দ্রসদনটা কোথায়?’
আমি ভালো করে দেখিয়ে দিতেই ওর সঙ্গে ছিল আরও
দু’জন। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘রবীন্দ্রসদনের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে, আমরা
সেখানে নাম লেখাব।’
আমি প্রথমটাই চমকে উঠেছিলাম। আমি জানতে চাইলাম,
‘তোমরা ঠিক যাবে কোথায়? রবীন্দ্র সদনে কোনও খেলার মাঠ নেই। রবীন্দ্র সরোবরে খেলার
মাঠ আছে।’ তিন বন্ধুর চোখে ‘দেহাতি গ্রামের’ সারল্য। সহজিয়া চাহনি। তিন বন্ধুর বয়স
তেরো থেকে চৌদ্দ বছর। একজন বলল, ‘হ্যা আমরা রবীন্দ্র সরোবর যাব। একজন আমাদের
এদিকে আসতে বলল।’
‘এখান থেকে অনেক দূর তোমাদের বাস ধরে যেতে হবে।’
আমার উত্তর শুনে একজন বলল, ‘আচ্ছা শিয়ালদহ কতদূরে হবে? এখান থেকে বাস পাওয়া যাবে?’
জানতে চাইলাম, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’ উত্তর পেলাম,
‘জয়নগর’। আমি মুচকে মুচকে হাসছি। আমার মনে মনে ‘ফাইট কোনি, ফাইট’। ওরা জয়নগর থেকে
এসেছে। ‘ফুটবলার’ হবে বলে। শহর থেকে পালিয়ে। কাঊকে না জানিয়ে। আমিও একদিন শহর থেকে
পালিয়ে এসেছিলাম। আমার শহর ‘নলহাটি’ থেকে। সাংবাদিক হব বলে। লেখক হব বলে। তারপর? লাল সূর্য নিজের অহংকারে হাসছে। আর একটু পরেই ফিরে যাবে ঘরে। পরের সকালে
ফিরে আসবে। ফিরে সে আসবেই।
সেদিন ওদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘কি করবে বাড়ি
যাবে? না ফুটবল ক্লাবে নাম লেখাবে?’ তিনজনেই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল।
বিস্ময়! অথবা ব্যর্থতার গ্লানি এবং অচেনাকে না চেনার কৌতূহল? তিনজনেই একমত হল, ওরা
শিয়ালদহ যাবে। আমি আবার পিছনের দিকে গিয়ে ‘নাট্য একাদেমী’-এর সামনে থেকে ওদের বাস
ধরিয়ে দিলাম। বাস আসার আগে একজন বলল, ‘তোর কাছে টাকা আছে?’ সে বলল, ‘না নেই।’ আর
একজন বলল, ‘তবে কি হবে?’
আমি ফিরে গেলাম আমাদের ‘হয়ে গেছে’ বলার সময়ে। আশির
দশকে। ওদের শিখিয়ে দিলাম, ‘দুটো টিকিট কাটবে। আর একটা চাইলে বলবে হয়ে গেছে।
কন্ড্রাকটার বেশি কথা বললে বলবে আমরা স্টুডেন্ট আমাদের টিকিট লাগে না।’
তিনজনকে ‘নবান্ন-নিউটাউন’ রুটের শিয়ালদহগামী একটি
বাসে তুলে দিলাম। আমি ‘নাগরিক কলকাতা’-এর ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। বাসটা আমার পাশ
দিয়ে যাচ্ছে। ওরা তিনজন বাসের ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কাকু হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
আমিও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার আউরালাম। সঙ্গে সঙ্গে বললাম,
‘ভাঙা হাটে ভাঙা ভাষা/ নতুন বছরে ভাঙা ভাঙা প্রত্যাশা’।
Happy New Year 2018
No comments:
Post a Comment