সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভাবছে
প্রেস কাউন্সিল? :
কলকাতা প্রেস ক্লাবকে ধন্যবাদ। ২০০১৭ সালে নতুন কমিটি গত কয়েক বছরের
ক্লাবের ক্লান্তি কাটিয়ে একটার পর একটা সামাজিক অনুষ্ঠান করে ‘সাংবাদিক’-দের আপন
ভুবন চেনাচ্ছে। কলকাতা তথা রাজ্যের সাংবাদিকরা আরও স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের ভাষায়
কথা বলতে পারছে। নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে সংবাদ
মাধ্যমের এই দায়িত্ব প্রেস ক্লাব, কলকাতা-র পরিচালন কমিটি সভাপতি স্নেহাশিস শূরের
নেতৃত্বে সুচারুভাবে নিয়েছে বলা যেতে পারে। এবং সুনিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট সংস্কৃতির
ছোঁয়ায় রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম পরিণত হতে চাইছে। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ
বেলায়। ঝা চক চকে কলকাতা শহরের আলোকিত ছন্দে। যে কথা প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার
চেয়ারম্যান সি কে প্রসাদ সম্প্রতি তাঁর কলকাতা সফরে উল্লেখ করেছেন। একুশ শতাব্দীর
দ্বিতীয় দশকে প্রেস ক্লাব যে শুধুমাত্র সন্ধ্যাকালীন বিনোদনের জন্য নয়। আরও
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট রয়েছে, সীমাবদ্ধ বৃত্তে সাংবাদিকরা আটকে থাকে না, সেই ভাষা
আমাদের চিনতে সাহায্য করছে ক্লাবের বর্তমান কমিটি। সাংবাদিকদেরও অনেক অনেক বড় আকাশ
আছে। সংকীর্ণ কলাম লেখার জন্য
সাংবাদিকরা জন্মায় না। জাত, বর্ণ, ভাষা, ধর্ম সব কিছুর উর্ধে উঠে সংবাদ মাধ্যমের
কর্মীরা আমন্ত্রণী মঞ্চে নয় নিজেদের ‘নোটবুক’-এ গঠনমূলক মুচলেকা দিতে পারে। সকল
সাংবাদিকের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে। সব ভাষার সংবাদ মাধ্যমের ঐকতান হয়ে যায় একদেহে
লীন। সাংবাদিকদের কোনও জাত হয় না। সাংবাদিকদের কোনও সীমান্ত হয় না। তাঁরা যেমন
সমালোচনা করতে জানে। সত্যের জন্য সমালোচনা মেনে নিতেও পারে। গত কয়েক মাসের ক্লাবের
কর্মসূচী এই বার্তা আমাদের দিচ্ছে। আগামীতে আরও গঠনমূলক সাংস্কৃতিক ভাষাবৃত্তে
আমাদের নিয়ে যাবে কলকাতা প্রেসক্লাব।
‘Press Club, Kolkata, deeply mourns
the sad demise of veteran journalist Sukharanjan Sengupta, who
passed away in Kolkata this evening after a brief age related ailments. He was
around 85 years and has been in the profession of journalism for more than 60
years.
He was one of the last generation of dhoti clad inquisitive
political reporters, who had direct access to senior politicians as well as
bureaucrats. He served in Lok Sevak, Jana Sevak, Jugantar and Anandabazar
Patrika. He covered Bangladesh liberation war extensively and authored several
books.
He is survived by his wife, son
and daughter. His last rites will be performed tomorrow, 10 December 2017.’
৯ ডিসেম্বর প্রেসক্লাব থেকে এই মেল পাওয়ার পর
কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কলকাতার নাগরিক সাংবাদিকদের মধ্যে
সুখরঞ্জনদা ছিলেন আলোর রেখা। তরুণ, নিঃসঙ্গ, দলছুট, বেতনছুট, কর্মচ্যুত
সাংবাদিকদের প্রেরণা ছিলেন তিনি। নির্ভীক, সাহসী, উদার জীবনবোধে, সামাজিক
মূল্যবোধে এবং জাতীয়তাবাদের এক অনন্য উদাহারণ ছিলেন সকলের প্রিয় সুখরঞ্জন
সেনগুপ্ত। আমি মাত্র কয়েকটা বছর সামনে থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ওই অল্প
সময়ের মধ্যে আমি তাঁর কাছ থেকে যেটুকু নেওয়া যায় সেটা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আটপৌরে
পোশাকে নিজেকে এতটাই ব্যস্ত রাখতেন অসততা নামক অদৃশ্য ‘ভাষা’ তাঁর কাছে ভিড় করতে ভয়
পেত। ‘সমঝোতা’ নামক দুর্বল শব্দ ছয় দশক সাংবাদিকতা করা সাংবাদিকের কাছে পথ হারিয়ে
ফেলত। এমনই দাপট ছিল তাঁর। সেই সাংবাদকিকের আবছায়া দীর্ঘ আরও দীর্ঘ হোক আমাদের
চলার পথে। ন্যায় আর সততা কখনও হারিয়ে যায় না। হারিয়ে যেতে পারে না। শিশির পড়ার
আওয়াজের সঙ্গে শব্দেরো নিজস্ব আওয়াজ আঁচে। সেই আওয়াজ আমাদের খুঁজে নিতে হয়।
ভালোবাসা এবং নিষ্ঠার আগুন কক্ষে।
বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, জ্যোতি বসু,
বুদ্ধেদব ভট্টাচার্য ছুঁয়ে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময় পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন। আজ ( ২০ ডিসেম্বর) প্রেস ক্লাবে এক সিনিয়র
সাংবাদিক বলছিলেন, সুখরঞ্জনদা বলতেন, ‘তুই কখনো রাজনীতিবিদদের ফোন করবি না।
অপেক্ষায় থাকবি। জানবি যে সাংবাদিককে রাজনীতিবিদ এবং সরকারি আধিকারিক ফোন করে সেই হল
সংবাদ মাধ্যমের আসল এবং প্রকৃত প্রতিনিধি।’
আজ ২০ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাব আয়োজন করেছিল সেই কিংবদন্তী সাংবাদিকের
স্মরণসভা। সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তকে নতুন করে কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না। হাঁটুর
উপর ধুতি, গায়ে একটা সাধারণ জামা। আইএএস, আইপিএস আধিকারিকদের ঘরে সাংবাদিক
সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের অনায়াস বিচরণ ছিল। ওইসব আধিকারিকদের ঘরে যাওয়ার জন্য সাংবাদিক
সুখরঞ্জনকে কখনও আগাম অনুমতি নিতে হয়নি। এবং তাঁর সময়কালে রাজ্যের আমলারা তাঁর
কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। দপ্তরের কাজ কি ভাবে আরও ভালোভাবে করা যায়। আজকের ওই স্বর্ণ
সময়ের ডালি সাজিয়ে দিলেন তাঁর সময়ের সমসাময়িক প্রবীণ সাংবাদিকরা। আমরা শুনলাম।
সকলের কাছে আক্ষেপ থেকে গেল সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের স্মরণসভায় সাংবাদিকদের
উপস্থিতির হার নিয়ে। মাত্র তিরিশ-পয়ত্রিশ জন
সাংবাদিক আমরা আজকের স্মরণসভায় হাজির ছিলাম। এটা সংবাদ মাধ্যমের কাছে ভাঙা হাটের
বার্তা দিত চাইলেও প্রবীণ সাংবাদিকরা তাঁদের স্মৃতিসুধায় আমাদের সৃষ্টিশীল
সাংবাদিকতার মিছিলে পৌঁছে দিয়েছেন। দৈনিক
স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ দু’টি প্রস্তাব দিলেন প্রেসক্লাবের
বর্তমান কমিটিকে। তাঁর প্রস্তাব সুখরঞ্জনদার কর্মজীবন নিয়ে একটি
পুস্তিকা করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এবং সম্ভব হলে তাঁর নামাঙ্কিত
একটি পুরষ্কার চালু করা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। প্রেস ক্লাবের বর্তমান সম্পাদক
কিংশুক প্রামানিক। দায়িত্বের সঙ্গে বললেন, ‘আমরা এই প্রস্তাব কমিটিতে আলোচনা করে
সিদ্ধান্ত নেব।’
মেঠো সাংবাদিকদের নগর কলকাতা চেনানোর সাংবাদিক
সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের স্মরণ সভার আগে আমরা আরও এক নবীন সাংবাদিকের কথা শুনেছি মাত্র
দু’দিন আগে। সোমবার ১৮ ডিসেম্বর প্রেসক্লাব আয়োজন করেছিল প্রয়াত সাংবাদিক সুমিত
সেন স্মারক বক্তৃতা। ওই দিনের অনুষ্ঠানে
আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। এদিনের বিষয় ছিল, ‘’সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা ও সাম্প্রতিক
ঘটনাবলী।‘’ এদিনের স্মারক বক্তৃতার মূল বক্তা ছিলেন ‘প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’-এর
চেয়ারম্যান বিচারপতি সি কে প্রসাদ। সোমবার কলকাতায় সুমিত সেন স্মারক বক্তৃতায়
বিচারপতি প্রসাদ বলেন, ‘’সংবাদমাধ্যমগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার যদি
সমাধান করা যায়, তা হলে অন্য সব জট কেটে যাবে।‘’ চলতি বছরে অগস্ট মাসে প্রকাশিত
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের একটি সমীক্ষা রিপোর্টের বিষয়ে উল্লেখ করেন তিনি। সেই
রিপোর্টে আছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিশ্বের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের সূচকে
দ্বিতীয়স্থানে রয়েছে। বিচারপতি প্রসাদ বলেন, ‘’আমি এই রিপোর্টের সঙ্গে পুরোপুরি এক
মত পোষণ না করলেও, তা নস্যাৎ করতেও পারছি না। এ ক্ষেত্রে রাস্তা একটাই। সেটা হল,
সঠিক এবং সত্যনিষ্ঠ ভাবে সংবাদ পরিবেশন করা।’
সত্যের পথে হাঁটা আমাদের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ সাংবাদিক
সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের জীবনালেখ্যের সঙ্গে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি আমরা। প্রেস
ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস শূর এদিন বলেন, ‘নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় সুমিতের অবদানের
কথা স্মরণে রেখে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে।’
অন্ধকার যতই থাক বিন্দু বিন্দু আলোর সীমানা আমরা
খুঁজে পাই সুমিত সেনের সাংবাদিকতার সীমানাহীন স্বপ্নে। বিচারপতি প্রসাদ এদিনের
বক্তব্যে গৌরি লঙ্কেশ এবং ত্রিপুরার সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করেন। সমস্ত দেশে
হরিজন সাংবাদিকদের নিয়ে ভাবতে সংবাদ মাধ্যমের নামীদামী এডিটর সহ ম্যানেজমেন্ট
সম্ভবত ভুলে যায়। রাজনীতির পচা পাঁকে ওইসব সাংবাদিক একদিন সত্যমিথ্যা সমস্ত দায়
মাথায় নিয়েও অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে আদর্শ সাংবাদিকের অবস্থান থেকে কাজ করে যায়।
নিজেদের ‘শ্রমজীবী’ সাংবাদিক বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এই সব সাংবাদিকের দল। কাজের
খোঁজে ‘পরিযায়ী সাংবাদিক’-এর মতো এই আকাশ ওই আকাশ ঘুরে সংবাদ মাধ্যমকে আঁকড়ে বেছে
থাকতে চায়! ১৮ নভেম্বর প্রেস ক্লাব কলকাতার মঞ্চে বিচারপতি প্রসাদ এই বিষয়টি ভুলে
যাননি। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এবং সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা
দেওয়ার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘’সাংবাদিকদের বাইরের সমস্যা থেকে
ভিতরের সমস্যা অনেক বেশি। একজন সাংবাদিকের যদি আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকে
তাহলে সে আরও মন খুলে কাজ করতে পারে।‘’
প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-কে আরও একটি বিষয় ভেবে
দেখার জন্য অনুরোধ করব। সাংবাদিক পরিচয়ে কেন কোনও সাংবাদিক ব্যাঙ্কের ‘ক্রেডিট
কার্ড’ পাবে না? সাংবাদিক সংগঠিত সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হোক অথবা অসংগঠিত সংবাদ
মাধ্যমের কর্মী হোক। কর্পোরেট সংস্থাগুলি কেন সাংবাদিকদের জীবীকাকে স্বীকৃতি দিতে
আগ্রহী নয়? আশা করি এই অভিঞ্জতা সব সাংবাদিকের আছে। ব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার সময়
সাংবাদিকদের বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিকতার প্যারাগ্রাফ টপকে তবেই কোয়ালিফাই করতে হয়।
সেগুলি অনেক সময় নৈতিক অবস্থান থেকে মেনে নেওয়াটাও কঠিন হয়ে দেখা দেয়। প্রাসঙ্গিক
হবে এদিনের তাঁর দীর্ঘ বৈঠকে সাংবাদিকদের কল্যাণে কোনও প্রকল্প করা যায় কিনা সে
বিষয়ে প্রেস কাউন্সিল ভাবন চিন্তা করছে বলে জানান সংস্থার চেয়ারমযান। দেশের চতুর্থ
স্তম্ভের মর্যাদা যেমন সাংবাদিকরা রক্ষা করবে পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও ভাবতে হবে সৎ,
সাহসী, গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের কথা। রাজনীতির উর্ধে উঠে তাঁদের পাশে রাষ্ট্র
না দাড়ালে, আইনসভা, বিচারসভা, না দাঁড়ালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম কোনওদিনই সাবালক হতে
পারবে কি?
No comments:
Post a Comment