ওরা ওদের মতো, সহানুভূতি নয়
আসুন ওদের পাশে থাকি:
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষ দিকের ঘটনা। আমাদের শহর নলহাটিতে নতুন একজন
সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক এলেন। সংক্ষেপে বিডিও বলে থাকি আমরা। ভদ্রলোক নিজে অত্যন্ত
ভদ্র এবং সুদর্শন। পরিবারের সদস্যদের দেখলে বোঝা যেতো তাঁরা কঠোর সংগ্রামের মধ্যে
কাটিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই নতুন বিডিও যিনি এসেছিলেন তাঁর বাবা ধোপার কাজ
করে ছেলেকে ‘ডবলুই বিসিএস’ পাশ করিয়েছিলেন। চাণক্য নামক কোনও দার্শনিক বা নেতা
তাঁকে ধরতে হয়নি ছেলেক বিডিও করার জন্য। চাণক্যবাবুদের ধুতি,
পাঞ্জাবি, শাল পিটিয়ে পিটিয়ে ছেলেকে বিডিও করেছেন। বিডিও সাহেবের বাবাকে
দেখলেই তাঁর লড়াই বোঝা যেত। বাবা এবং ছেলে তাঁরা নমস্য ব্যক্তি ছিলেন। ভদ্রলোক
বিডিও হওয়ার পরে আমাদের শহরে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয়েছিল। নতুন ব্লক আধিকারিক হয়েও
তিনি এতটাই ভারসাম্য রেখেছিলেন সে কথা আজও মনে করা যায়। কারণ দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই
করে ‘নাগরিক জীবনে’ আসার পরেও কোনরকম দেখনদারি ছিল না। আবার জিরাফের মতো গলা তুলে
লড়াইয়ের কথাও কোনদিন বলেননি। সংযম মেনে চলতেন। এই প্রতিবেদনে
ভদ্রলোকের নাম লিখছি না। আমাদের অঞ্চলে সকলে তাঁকে ‘দাদা’ বা অমুকদা বলে ডাকলেও
আমি ‘স্যার’ বলতাম।
আমাদের পাড়ায় সমষ্টি উন্নয়ন দপ্তরের একটি খেলার
মাঠ আছে। সম্ভবত আজও আছে। আমাদের খেলার মাঠে এক ঠিকাদার একদিন মাঠের এক প্রান্তে
কয়েকশো ইট সাজিয়ে রেখে দিয়েছিল। ব্লক অফিসের বড়বাবুকে অভিযোগ করেও ইট সরাতে
পারিনি। আমাদের খেলতে অসুবিধা হত। শীতের সকালে একদিন আমরা ইট সরানোর জন্য
প্রত্যেকে দুটো করে ইট নিয়ে সরাচ্ছিলাম। আট দশজন ছেলে আমরা ছিলাম। হঠাত বিডিও
সাহেব এসে হাজির। তিনি ডাই করা ইটের বোঝার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের পর পর দাঁড়াতে
বললেন। তিনি নিজে পর পর সাজিয়ে রেখে দেওয়া ইটের কাছে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত থেকে আমরা
ইট নিয়ে সরাতে থাকলাম। প্রত্যেকে হাতে হাতে একঘণ্টার লড়াইয়ের পর ইট সরিয়ে ফেললাম।
বিডিও সাহেবের কাছে সেই প্রথমবার ‘সবে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ আপ্তবাক্য
রপ্ত করেছিলাম।
বিডিও অফিসের পাশের বাড়িটা ছিল পশু হাসপাতাল। সেই একই
বছরে পশু হাসপাতালে এক ভদ্রলোক পশু চিকিৎসক হয়ে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার
ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন হাসপাতালে বসে আছি এক ভদ্রলোক একটা সাদা পেঁচা
নিয়ে এলেন। শিক্ষিত সমাজ সচেতন লোক। এসেই বললেন ‘ডাক্তারবাবু এই পেঁচাটা আমার
বাড়ির সামনে পরে ছিল। কতকগুলো কাক ওকে তাড়া করছিল। দিনেরবেলায় ওরাতো দেখতে পায় না।
দেখুন পেঁচাটা আহত। ওর ডানায় লেগেছে।’
পেঁচাটাকে যত্ন করে দেখলেন ডাক্তারবাবু। ডানায়
ওষুধ দিয়ে ‘ফার্স্টএইড’ চিকিৎসা করে দিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে সেদিন ওই শীতের
সকালে আমার বন্ধু হুতোম বসে ছিল। হাসপাতালের ছাদে। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় আমাদের
বাড়িতে, সেই সম্পর্ক আজও থেকে গেছে। সেদিন হুতোম আমাকে বলেছিল, ‘আমার বন্ধুটাকে
দিনের আলোয় সুযোগ বুঝে ওরা মারল। আমি মারব না। ওদের রাতের অন্ধকারে পেলেও মারব না।
আমি তোদের গান্ধিবাদী দর্শন জানি। আমি বাবুকে বললাম বাবু ডাক্তারের কাছে নিয় এলো।’ হুতোমের বাবু তাঁর পর থেকে আহত পাখি পেলেই পশু
হাসপাতালে নিয়ে আসত। পরে আহত মানুষদের জন্যও হুতোমের কথা
শুনে নলহাটি, রামপুরহাট, সিউড়ি, বর্ধমান এবং কলকাতার বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসার
জন্য চাঁদা তুলে নিয়ে আসতেন ভদ্রলোক।
সম্প্রতি ‘পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’,
কলকাতা চ্যাপ্টারের উদ্যোগে রোটারি সদনে একটি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের
শিরোনাম ছিল ‘ডিজি এবিলিটি’ এম্পাওয়ারিং দ্য ডিফারেন্টলি- এবল্ড। সংস্থার নামের
মধ্যেই আমাদের শিরোনাম লুকিয়ে রয়েছে। সংগঠনের কলকাতা চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান
সৌমজিৎ মহাপাত্রের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ আছে। সাংবাদিকতা করার সুবাদে। তিনি
আমন্ত্রণ জানানোর সময় বলেছিলেন, সহানুভূতি নয় আমাদের পাশে থাকুন। আমন্ত্রণ পেয়ে ১৩
ডিসেম্বর গিয়েছিলাম রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে। ‘অসাধারণ’ বললে খুব কম বলা হয়। একটি
ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান সেদিন দেখেছি। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কলকাতার ‘মনোবিকাশ’
কেন্দ্রের জনা দশেক প্রতিবন্ধী শিল্পীর ‘জ্যাজ মিউজিক’ বাজনা দিয়ে। একজন প্রতিবন্ধী মেয়ে তবলা এবং ড্রাম বাজালেন। যে উচ্চ ঘরানায় বাজালেন অনেককেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। দশজন শিল্পী কেউ
বাঁশি, কেউ বেহালা, কেউ গিটার, কেউ ভারতীয় ঘরানার বিভিন্ন খোল বাজিয়ে আমাদের তাক
লাগিয়ে দিয়েছিল। সামনে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না এঁদের কি যোগ্যতা আছে।
ওরা ভারতীয় সঙ্গীত ঘরানাকে যে শিল্প সুষমায় পরিবেশন করলেন, সংগঠনের সঙ্গে গলা
মিলিয়ে সত্যিই বলতে হয় ‘Empowering the Differently- Abled’ । পরের পর চমক সেদিন আমদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতা প্রদানকারী মন্ত্রকের
অধীনস্থ কেন্দ্রীয় দিব্যঞ্জান নির্দেশক বোর্ডের অভিঞ্জ সদস্য পঙ্কজ মারু বক্তব্য
রাখেন। তিনি তাঁর ভিডিও স্লাইডের মাধ্যমে দেশের প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত তথ্য তুলে
ধরলেন। তাঁর বক্তব্য থেকে জানতে পারলাম ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত
শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভারতে কোনও আইন ছিল না। এই আইন
১৯৯৫ সালে তৈরি হয়। সেই আইন ২০১৬ সালে সংশোধিত এবং পরিবর্তিত হয়ে ‘The Rights of persons with
Disability act, 2016’ নামে নতুন আইন হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারে সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতা প্রদানকারী মন্ত্রকের মন্ত্রকের
ওয়েবসাইট লিখছে, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ২.৬৮ কোটি মানুষ প্রতিবন্ধী। দেশের
আনুমানিক ১৩০ কোটি মানুষের শতকরা হিসাবে ২.২১ শতাংশ।
‘’The Department of
Empowerment of Persons with Disabilities in the Ministry of Social Justice
& Empowerment facilitates empowerment of the persons with disabilities, who
as per Census 2011 are 2.68 crore and are 2.21 percent of the total population
of the Country. These include persons with Seeing, Hearing, Speech, Movement, Mental
Retardation, Mental Illness, Multiple Disability and any other disabilities.’’
এই হিসাব ধরে পঙ্কজ মারু আরও উল্লেখ করেন, দেশে
মাত্র ২ লক্ষ ৭৩ হাজারের কিছু বেশি ইউডিআইডি
(UDID) কার্ড প্রতিবন্ধী মানুষকে দেওয়া
সম্ভব হয়েছে। এটা সারা দেশের হিসেব। দেশের জনসংখ্যার ২.৬৮ কোটি ব্যক্তি
প্রতিবন্ধী। অথচ সারা দেশে এপর্যন্ত কার্ড দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র ২ লক্ষ ৭৩
জনকে। পশ্চিমবঙ্গে একটিও UDID কার্ড এপর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই
বিষয়ে রাজ্যের নারী শিশু এবং সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজার সঙ্গে ফোনে
কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, ‘’আমি ঠিক জানি না। আমাকে বিস্তারিত খবর নিয়ে জেনে বলতে
হবে।‘’
SWAVLAMBAN CARD
About
Unique Disability ID
‘’Unique
ID for Persons with Disabilities’’ project is being implemented with a view of
creating a National database for PwDs, and to issue a Unique Disability
identity Card to each person with disabilities. The project will not only
encourage transparency, efficiency and ease of delivering the government
benefits to the person with disabilities, but also ensure uniformity. The
project will also help in stream-lining the tracking of physical and financial
progress of beneficiary at all levels of hierarchy of implementation- from
village level, block level, District level, state level and National level.
পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, কলকাতা
চ্যাপ্টারের অনুষ্ঠানে প্রকাশিত ‘সুভিনিয়র’ থেকে একটি তথ্য পাচ্ছি।
Disabled Population by type of
Disability of West Bengal
Visually
Impaired: 424473
Hearing : 315192
In
Speech : 147336
Locomotors : 322945
Mental
Retardation: 136523
Mental
Illness : 71515
Multiple
Disability : 196501
Any
Other (CP/Austin): 402921
Total
number of
disabled
persons : 2017406
The
scenario, through slow rising awareness, especially dedicated efforts of people
working towards the cause, has been changing. But the number is increasing too,
turning the challenges ahead tougher. Kolkata and other towns are a tad better
in comparison of the suffering populace in semi-urban or mufassal areas,
villages and near-remote localities. Trained manpower and care giver in deaf-blind,
multiple disability, developmental therapy, sign language interpretation,
mobility science, developmental rehabilitation, early intervention and rehabilitation
management etc is the need of the to deal with this huge number. This will
enable our mainstream education to include them, which in turn open new
frontiers for their empowerment.
এদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পদ্মশ্রী সুধা কাউল।
তাঁর তথ্য সম্বলিত স্লাইডশো থেকেও প্রতিবন্ধী পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল।
‘প্রেমশ্রী’ নামে প্রতিবন্ধীদের একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রযোজনা আমরা দেখলাম। পাশাপাশি দর্শকদের জন্য ছিল
‘রিদম ডিভাইন পোয়েটস’ নামে অন্য একটি ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অসাধারণ অনুষ্ঠান। অনিন্দ্য সুন্দর সেই অনুষ্ঠানের
বর্ণনা করা যায় না। চোখে না দেখে বা কানে না শুনে লেখায় আমরা কতটা আনতে পারি?
চারজনের একটি দল। একজন শিক্ষিত তরুণ গিটার বাজিয়ে বাংলা, ইংরেজি গান করে। সে অন্ধ।
তাঁকে কেন্দ্র করেই একাঙ্ক নাটক আবর্তিত হয়। অসাধারন সেই দৃশ্যকল্প। এদিনের
অনুষ্ঠানে অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলেন, মুকেশ জৈন, সিইও, ন্যাশনাল ট্রাস্ট,
এলিজাবেথ নেউভিলে, ডাইরেক্টর, কিস্টোন ইন্সটিটিউট, ‘শিশুর সেবায়’ সংগঠনের
প্রতিষ্ঠাতা মিচেল হারিসন।
অনুষ্ঠান দেখে রোটারি সদনের বাইরে দাঁড়িয়ে একজনের
সঙ্গে কথা বলছি, গাছের উপরে বুড়ো হুতোম বসে আছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল, ‘অভিনয় দেখে
অভিনেতা হয়ে যাস না। মানুষের জন্য যারা কাজ করে তাঁদের মানবিকতা থাকতে হয়। ৪১ বছর
আগে যা বলেছিলাম আজও বলছি। অপমান, হেনস্থা, ঘৃণা যারা করার করবে। ওদের থেকে দূরতব
রেখেই মানবিক কাজ করতে হয়।’
মনে মনে বললাম ঞ্জানবুড়ো শীতবেলায় গরম গরম বুলি
কপচাচ্ছে। আমি সেদিন কোনও উত্তর না দিয়ে চলে এসেছিলাম।
No comments:
Post a Comment