দীপেন্দু চৌধুরী
বিংশ শতাব্দী অথবা উনবিংশ শতাব্দীর ভারতেও একটা সময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ
ব্যবস্থা আদিবাসী সমাজে প্রকট ছিল। বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি আসাম,
মেঘালয়ের কয়েকটি পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছিলাম। সেই সময় আমার এই
বিষয়ে কিছুটা অভিঞ্জতা হয়েছিল। এছাড়া আমাদের বীরভূম জেলা ছোট নাগপুর সংলগ্ন হওয়ার
কারণে আমরা ছোট বয়স থেকেই আদিবাসীদের জীবন যাত্রা দেখতে অভ্যস্ত। ইতিহাসবিদরা এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে
পারবেন। পাহাড়ি অঞ্চলে এই ব্যবস্থা আজও অনেকটা দেখা যায়। যদিও আমাদের দেশের
আর্থ-সামাজিক কাঠামো আধুনিক হয়ে গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার হয়েছে। সেই
সঙ্গে প্রচার মাধ্যমের রমরমার কারণে তথা-কথিত ‘বাবু-সমাজ’-এর প্রভাব প্রত্যন্ত
পাহাড়ি অঞ্চলেও পড়েছে। সময়ের নিয়মে সেইসব অঞ্চলেও পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব বর্তমানে
ব্যপকভাবে লক্ষ করা যায়।
প্রশ্নটা আসছে এইখান থেকেই। ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সংসদীয় গণতন্ত্রে
মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। কত বছর হবে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর
৭১ বছর অতিবাহিত। কিন্তু একটি আধুনিক গণতন্ত্রের আইনসভায় মহিলাদের আসন পুরুষদের
সমানুপাতিক নয়। দেশের প্রথম সারির দুটো প্রধান
রাজনৈতিক দল পরস্পরকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত। বিজেপি আবার অভিযোগ তুলছে দলিত দলগুলির
নেতৃত্ব ভোট ব্যাঙ্কের কারণে এই সংরক্ষণ চাইছে না। যদিও কংগ্রেস নিয়ে বিজেপি এই
অভিযোগ করতে পারবে না। কারণ ইউ পি এ জামানায় আমরা মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং মহিলা
অধ্যক্ষ পেয়েছি। মহিলা রাজ্যপালও ওই একই সময়ে আমাদের দেশ পেয়েছে। সংসদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে মহিলা
প্রতিনিধি বসতে পেড়েছিলেন, ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের উজ্জবল ব্যক্তিত্ব সনিয়া
গাঁধির উদ্যোগে। ইউপিএ সরকারের তৎকালীন চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধির আন্তরিক
উদ্যোগে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। কংগ্রেসের দাবি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি
পুরসভা-পঞ্চায়েতে মহিলা সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যদিও ভারত এর আগে কংগ্রেস দলের
মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। আইনমন্ত্রক সূত্রে খবর, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ
একটি চিঠিতে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধিকে লিখেছেন, ইউপিএ শরিকদের মতান্তরের কারণে
ইউপিএ আমলে এই বিলটি সংসদে পাশ হয়নি। বিলটির মেয়াদ শেষ হতে দিয়েছিল কংগ্রেস।
পরের ঘটনাগুলি আমরা উল্লেখ করি। এক শ্রেণীর
সামন্তপ্রভুদের রাজনৈতিক বিরোধিতায় ১৪ বছর ধরে আটকে ছিল মহিলা সংরক্ষণ বিল। ১৯৯৬
সালে বিলটি সংসদে প্রথম পাশ হয়। কিন্তু সংসদে বিরোধিতার কারণে তিন তিনবার বিলটির
মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এবং আটকে যায়। সনিয়া গাঁধির উদ্যোগেই ২০১০ সালে রাজ্যসভায় ওই
বিল পুনর্বার পাশ হয়। সেই বছরও বিল পাশের সময় সংসদের উচ্চকক্ষ রণক্ষেত্রের চেহারা
নেয়। বিজেপি দলেও এই বিল নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। কারণ ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য
সংরক্ষিত হলে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে অনেক পুরুষকে প্রার্থীপদ খোয়াতে হবে। তবে
বিজেপি সূত্রে খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ কয়েকজন শীর্ষনেতা এই বিল আনার
পক্ষে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা সনিয়া গাঁধি এটা আঁচ পেয়েই একটি চিঠি লেখেন। এবং
কংগ্রেসের মহিলা সেলকে স্বক্রিয় করতে মাঠে নামান।
২০১৭ সালের শেষের দিকে সনিয়া গাঁধি বর্তমান
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি চিঠি লিখে মহিলা বিল পাশ করানোর অনুরোধ করেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে সনিয়া গাঁধি এই চিঠি
লেখার পর সুস্মিতা দেব এবং প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীর নেতৃত্বে পাঁচজন কংগ্রেস মহিলা
নেত্রীকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করান। মহিলাকংগ্রেসের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের
বক্তব্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও, তিন তালাক, মহিলা
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো বিষয়গুলি সামনে এনে নারীদরদি ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চাইছেন। যদি
সেটা সত্যি হয় তাহলে কেন শীতকালীন অধিবেশনে মহিলা বিল পাশ করানোর কথা ভাবা হচ্ছে
না? কারণ এটা সংবিধান সংশোধনী বিল। এই বিলকে কার্যকরী করা এক দীর্ঘমেয়াদি
প্রক্রিয়া। যদিও ২০১৭ সালের শীত, ২০১৮ সালের গ্রীষ্ম থুরি বাজেট অধিবেশন পেরিয়ে
বর্ষা এসে গেল। কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ বিল আজও আলোর মুখ দেখতে পেলনা। ২০১৭ সালের
মহিলা কংগ্রেসের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে আরও বক্তব্য ছিল, এই বিল শীতকালীন অধিবেশনে
পাশ করাতে না পারলে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আইন রুপায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা চিঠিতে সনিয়া
গাঁধি লিখেছিলেন, ‘’২০১০ সালে রাজ্যসভায় বিলটি পাশের পর নানা কারণে লোকসভায় পাশ
করানো যায়নি। লোকসভায় আপনার সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে বিলটি পাশ করান। মহিলাদের
ক্ষমতায়নের লক্ষে কংগ্রেস তা পূর্ণ সমর্থন করবে।‘’
পাশাপাশি বিজেপির উপলব্ধি নির্মলা সীতারামনকে
প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার পর থেকে বিজেপি দলের মহিলাদের সমর্থন বেড়েছে। এবং মহিলাদের
ক্ষমতায়নের পক্ষে বিজেপি নেতৃত্ব এই বারতাও দেওয়া গেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের
আগে সেটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই বিল পাশের
পুরো কৃতিত্বও নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপির
এক সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘’বিলটি সংসদের পরের অধিবেশনে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু
হয়ে গেছে।‘’ তারপরেও গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কালো-সাদা জল বয়ে গেল কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ
বিল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে গেল।
বিলটি পাশ হলে তা কতটা গুরুত্ব দাবি করতে পারে
সেটা কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি আগেই টের পেয়েছিলেন। চলতি বছরের মে মাসে তিনি
মহিলা কংগ্রেসকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক-তৃতীয়াংশ আসনে মহিলা প্রার্থী
বাছাই করতে রাহুল গাঁধি সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুস্মিতা দেবকে বিষয়টি
নিয়ে তৃণমূল স্তরে সক্রিয় হওয়ার জন্য বলেন। পরে সুস্মিতা দেব বলেন, ‘’...‘পরছায়া’
প্রার্থী চান না রাহুল গাঁধি। পঞ্চায়েতে ভোটে যেমনটা হয়ে থাকে। আমাদের সভাপতির
নির্দেশ বলুন বা তার ইচ্ছে কেউ স্বামী বা দাদার বকলমা হয়ে ভোটে দাঁড়াবেন না। মহিলা
কংগ্রেস নেত্রী হিসেবেই সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।‘’
ওইদিন সুস্মিতাদেবী আরও বলেন, ‘’আমাদের দল যাতে
হঠাত করে কোনও সঙ্কটে না পড়ে সেই ব্যাপারে মহিলা কংগ্রেস বেশ কিছু পদক্ষেপ করার
জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রথম পর্বে থাকছে, মহিলা কংগ্রেসের বিভিন্ন উপ-শাখা গঠনে জোর
দেওয়া। রাজ্যে রাজ্যে গড়ে তোলা হয়েছে
মহিলাদের ‘লিগ্যাল সেল’। মহিলা কংগ্রেসের একটি রিসার্চ সেলও তৈরি করা হয়েছে। যুব
কংগ্রেসের মতো ‘যুব মহিলা কংগ্রেস’ গঠন করা যায় কিনা তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু
করেছি আমরা।‘’
সিপিএম দল থেকেও একই দাবি উঠেছে। দলের ২২তম পার্টি কংগ্রেসে হায়দরাবাদে মহিলা বিল সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন
সূর্যকান্ত মিশ্র। এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত এই পার্টি কংগ্রেসে সূর্যকান্ত মিশ্রের
আনা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, আইনসভায় অবিলম্বে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিলকে
আইনে পরিণত করতে হবে। পার্টির ২২তম কংগ্রেস এই দাবি জানাচ্ছে। দলগতভাবে আহ্বান
জানানো হচ্ছে যে, বিজেপি সরকারকে এই বিল যাতে দিনের আলো দেখতে পায় তার জন্য আইনে
পরিণত করতে হবে। এটাকে বাধ্য করানোর জন্য সমস্ত অংশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের
সোচ্চার হতে হবে। প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সূর্যকান্ত মিশ্র আরও বলেছিলেন,
‘’মহিলাদের সমানাধিকার দেওয়ার দাবিটি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বেজিং
কনভেনশনে এবিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের পর সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল, আইনসভায়
মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের। বিশ্বের দু’ই-তৃতীয়াংশ কাজই মহিলারা করে। যদিও তাঁরা
ভোগ করে এর খুবই সামান্য অংশ। সিপিএম প্রথম থেকেই ধারাবাহিকভাবে এই প্রস্তাবের
পক্ষে লড়াই করে আসছে।‘’
তৃণমূল কংগ্রেস দলগতভাবে কংগ্রেসের ডিএনএ। তারাও
সংসদে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের পক্ষে। চলতি বছরে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে
তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ধর্মতলায় এক জনসভায় বলেন, ‘’আমরা ৫০
শতাংশ সংরক্ষণ করেছি। আমাদের নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি সংখ্যা হচ্ছে ৩৩ শতাংশ।
বিল পাশ হওয়ার আগে আমরা করে দেখিয়ে দিয়েছি। তবে আমরাও চাই সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল
পাশ হোক।‘’
চলতি সপ্তাহে সংসদ শুরুর আগে মহিলা বিল নিয়ে
সোচ্চার হলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি। কংগ্রেস সূত্রে খবর, প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে রাহুল জানতে চেয়েছেন চলতি বর্ষাকালীন অধিবেশনে মহিলা
সংরক্ষণ বিল নিয়ে সরকার কী ভাবছে? এই বিল কী পাশ হবে? সভাপতি হিসেবে দলের হাল
ধরলেন নিজেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের
তরফে ৩২ লক্ষ মহিলার স্বাক্ষর ইতিমধ্যে সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ রাজনীতির উর্ধে উঠে
গণতন্ত্রের পক্ষে কথা রাখা। রাহুল গাঁধি পরে একটি টুইট করেন। টুইটে তিনি বলেন,
‘’প্রধানমন্ত্রী মহিলাদের ক্ষমতায়নের রক্ষাকর্তা বলেন নিজেকে। তিনি বিল পাস করুন,
কংগ্রেস নিঃশর্ত সমর্থন করবে।‘’
প্রস্তাবিত বর্ষাকালীন অধিবেশন আজ থেকে শুরু
হয়েছে। সোমবার রাহুল গাঁধির লেখা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন একটি ‘ডিল’-এর প্রস্তাব
দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য
চিঠিটি তিনি নিজের ক্যাবিনেটের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে পাঠিয়ে আলোচনার
কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথামত আইনমন্ত্রী রাহুল গাঁধিকে লেখেন ‘’আমি ‘নতুন
ডিল’-এর প্রস্তাব দিচ্ছি। কংগ্রেস ও বিজেপি মিলে মহিলা সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তিন
তালাক এবং নিকাহ হালালার বিলটিও পাশ করুক। এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণী সংক্রান্ত জাতীয়
কমিশনকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার বিলটিও পাশ করানো হোক।‘’
টানটান উত্তেজনার মধ্যে থাকবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম
এবং রাজনীতি। একঝাঁক নতুন এবং তরুণের নেতৃত্বে একুশ শতাব্দীর ভারতীয় কংগ্রেস দল।
রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের উর্ধে উঠে ভারতীয় সংসদ কী ১৪ বছরের পুরনো বিল পাশ করে
আধুনিক গণতন্ত্রের স্তম্ভ আরও শক্ত করতে পারবে?
No comments:
Post a Comment