Thursday, 28 June 2018

শুধুমাত্র বামপন্থা নয় ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব তিনি.........



দীপেন্দু চৌধুরী 
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা প্রথম থেকেই দেখতে পাব বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল ভীষণ রক্ষণশীল। অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না? যতদূর জানি এই বিষয়ে অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত ঐক্য হয়নি। ১৯৬৪ সালে সিপিআই ভেঙ্গে সিপিএমের জন্ম যেমন চিন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দকে সামনে এনে দিয়েছিল, পাশাপাশি ১৯৬৯ সালের সিপিএম থেকে সিপিআই(এম-এল) গঠনের সময় অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ভূমিকা। এবং কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণসিপিআই, সিপিএমের সঙ্গে আড়াআড়ি পার্থক্য লক্ষ করা গেছে সদ্যগঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এম-এল) দলের। পরে এই দলটি ভেঙ্গে বিভিন্ন শাখা উপশাখা হয়েছে। সেই সব গোষ্ঠী সশস্ত্র বিপ্লবের নীতিতে বিশ্বাস রাখলেও ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দগুলিকে গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতীয় নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। সংসদীয় গণতন্ত্রকে এইসব দলগুলি গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়।  
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং
এই নামটির সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের স্রোত দীর্ঘদিন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের পাঁচ বছরে সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থীদের বিতর্কিত ভূমিকার কথা জানি। এই সময়ে ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে এক অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। সদরদুর্গে কামান দাগার মতই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় নিজের দলে এবং ভারতীয় বামপন্থী দলের তথাকথিত ঘূণ ধরে যাওয়া এক দর্শনকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন ভারতীয় সংসদের তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল একটি বামপন্থী দলের ‘হুইপ’কে অমান্য করেছিলেন। ভারতীয় উন্নত গণতন্ত্রের স্বার্থে তার সেই সিদ্ধান্ত আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। বিষয়টা কি ছিল? একটু উঁকি মেরে আসি।
২০০৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোটকে পরাজিত করে ডঃ মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস ইউপিএ সরকার গঠন করে। বামফ্রন্ট লোকসভায় ৬১ জন সদস্য নিয়ে বাইরে থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করে। বামেদের সমর্থনে কংগ্রেস জোট সরকারের স্পিকার হয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধি, প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ এবং স্পিকার সোমানাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই সরকার ভারতের গরীব নাগরিকদের স্বার্থে ন্যুনতম একটি সাধারণ কর্মসূচী প্রণয়ন করে। এই কর্মসূচীর আওতায় ছিল গ্রামের গরিব মানুষের জন্য ১০০দিনের কাজের ব্যবস্থা করা। তারপরের ঘটনা বাঁক নিল অন্যদিকে।
২০০৫ পর্যন্ত সিপিএম দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দগুলির প্রকট বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু সিপিএম দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রবাদপ্রতিম বামপন্থী নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সময় শারীরিক কারণে আর ততটা স্বক্রিয় থাকতে পারছিলেন না। কেরল এবং বাংলা লবির লড়াই ২০০৫ সালে ভারত সরকারের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিকে কেন্দ্র করে সামনে চলে এল। ভারত আমেরিকার সম্পর্কের বিষয়টা একটু আগে থেকে দেখি। ১৯৯৫ সালে নরসিমহা রাও সরকারের আমলে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৮ সাল পোখরান পারমাণবিক পরীক্ষার পর আমেরিকা সামরিক সহযোগিতা কিছুদিনের জন্য ঢিলেমি দিতে থাকে। ২০০০ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ভারতে আসার পর তৎকালীন বিজেপি সরকার আমেরিকার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালে বিজেপি সরকার বিদায় নেওয়ার পরে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আরও ভালো জায়গায় গেল। ২০০৫ সালে কন্ডোলিসা রাইস ভারতে এলেনতিনি সেই সময় ভারতকে নিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে গেলেন। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতি প্রকাশের আগে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হল। এই খসড়া চুক্তিটি পরে ভারত আমেরিকা ১০ বছরের জন্য প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি হিসেবে পরিচিত হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে দু’টি দেশ সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের সম্প্রসারণে কাজ করবে। এছাড়া সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগী হিসেবেও কাজ করবে। পরিবর্তে ভারত অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে কিছু ছার পাবে। আমেরিকার ‘হাইড অ্যাক্ট’-এর ১২৩ ধারায় এই চুক্তি হয়েছিল। আন্তর্জাতিকস্তরে আমেরিকার সঙ্গে তাঁদের দেশের নিউক্লিয়ার গবেষণা ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সামরিক এবং অসামরিক খাতে কেমনভাবে নির্ধারিত হবে তা ওই আইনের ১২৩ ধারায় নির্দিষ্ট করা আছে। এই চুক্তির পরেই সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। যদিও সরকারের পতন হয়নি। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করার শর্তে ইউপিএ সরকারের শরীক হয়। সিপিএম দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা সমর্থন তুলে নেবেএবং অধ্যক্ষ হিসবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করবেন। তৎকালীন সিপিএম দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ না করে দলকে বোঝাতে চাইলেন অধ্যক্ষ পদটি একটি নিরপেক্ষ ‘চেয়ার’। পদত্যাগ না করেও নিজেদের প্রতিবাদ জানানো যায়। অতি সুশৃঙ্খল একটি রেজিমেন্টেড বামপন্থী দল হিসেবে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল নাতাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হল।
সোমানাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেন না। নির্দল সদস্য হিসেবে পুরো সময় অধ্যক্ষের কাজ চালিয়ে গেলেন। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে এক নতুন ইতিহাস রচনা হল। ভারতীয় সংসদে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় বসু, অটলবিহারী বাজপেয়ী সহ একাধিক মেধাবী সাংসদের নামের সঙ্গে বাংলার ব্যরিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম যুক্ত হল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এক বনেদী পরিবারের সন্তান। বাবা নির্মল চট্টোপাধ্যের কাছ থেকে তিনি প্রাথমিক রাজনীতির পাঠ পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্সী কলেজেও তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। দেশে ফিরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। স্বনামধন্য ব্যারিস্টার হিসেবে নিজে প্রতিষ্ঠা পান। ইংল্যন্ডে থাকার সময় থেকেই আর এক ব্যরিস্টার তথা কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর কাছাকাছি আসেন। যিনি নিজে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন রজনীপাম দত্তের কাছে। সোম্নাথবাবু সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্রমশঃ ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
জ্যোতিবসুর মুখ্যমন্ত্রীর সময় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘শিল্প উন্নয়ন নিগম’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। যত দূর মনে পড়ে তার উদ্যোগেই আমাদের রাজ্যে প্রথম ‘শিল্প ও বাণিজ্য’ মেলা শুরু হয়। সিপিএম দলের জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত দু’টি গোষ্ঠী পৃথক ঘরানা বা অস্তিত্বের কথা আমরা জানি। সোমনাথবাবু ছিলেন জ্যোতি বসুপন্থী। সেই কারণে সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন সোমনাথবাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ। সুভাষদা যে কোনও বড় কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সোমনাথবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে নিতেন।  
২০০৯ সালের পর থেকে আমরা নজর করলাম একজন গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সোমনাথবাবু যে কোনও বিষয়ে মুখ খুলছেন। তার নিজের ভাষায় নিজস্ব শৈলীতে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ২০১৫ সালে ২ অগস্ট তিনি সংসদ অচল প্রসঙ্গে বলেন, ‘’....‘very agonising’ the freequent disruption of parliament and lamented the ‘inadewuancy’ of the position of the presiding officer.’’ সাম্প্রতিককালে দেশের অসহিষ্ণুতা, গোষ্ঠী সংঘর্ষ, দলিত নিগ্রহ নিয়েও সোমনাথবাবু বলেছিলেন. ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি বলেন,‘Intolerance divisiveness, corruption confrontations and disrespect for dissent are increasing vitiating the social-political system in the country.’’ ওই বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ১৯ জুলাই সিপিএম দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরে সীতারাম ইয়েচুরি নিজেদের ভুল স্বীকার করেন। এবং সোমনাথবাবুকে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। ইয়েচুরী বলেন, ‘Our veteran leader would be reinducted into the party, seven years after his expulsion.’’  
সোমনাথবাবু ছ’মাস আগে ২৩ জানুয়ারী The Economic Times পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি অল্প কথায় নিজের দল, ভারতীয় সাংসদ এবং সংসদীয় ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলেন। আমরা সেই সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ এখানে উল্লেখ করছি। লেখাটির শিরোনাম সহ উল্লেখ করলাম।
 Prakash Karat's win is Narendra Modi's win; CPM must partner Congress: Somnath Chatterjee
The crisis in CPM deepens with a visibly serious divide over its political tactical line. Even as the party faces steady erosion in its support base across the country, especially in the east, the distinct split in the decision and policy making bodies in the communist party has added to the gloom. The three day central committee meeting held in Kolkata has widened the fissure. In an exclusive interaction with The Economic Times, Somnath Chatterjee, former Speaker of the Lok Sabha however made the former general secretary Prakash Karat responsible for the mess. “Had Sitaram resigned on Sunday following the voting process, the party would have been on the path of being obliterated. He has been trying hard to put the pieces together, but there is a limit to tolerance,” said Chatterjee. 

A decade after his expulsion from the party for voicing his displeasure over the CPM voting against the United Progressive Alliance, Chatterjee is still a loyalist and upset. “In a sense, Karat’s victory is Modi’s victory. Under the previous general secretary, the party was on the course of extinction. All his decisions and policies cost the party a lot. And it started when he refused to allow Jyoti Basu become the Prime Minister, followed by his decision of withdrawing support from UPA,” he told ET sitting in his residence in Kolkata. 

“Time has come when the party members should seriously think about its continuance as a serious political entity, which will be able to provide protection to people from the disruptive and destructive forces like BJP and TMC and give them a different narrative, an alternative,” added the Communist stalwart .
’’
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় চারটে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেগুলি হল Keeping the faith, Memoirs of A Parliamentarian, The collected speeches of Somnath Chatterjee. এই বইগুলিতে তিনি নিজের মেধা এবং  অভিঞ্জতা বিনিময় করেছেন ভারত এবং সারা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সঙ্গে। একটি ছোট লেখায় তার সামগ্রীকতা কতটা আর আনা সম্ভব? ভারতের গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে তিনি একটি নতুন অধ্যায়। আমাদের বলতেই হবে শুধুমাত্র বামপন্থা নয় ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব তিনি.........
 

No comments:

Post a Comment