বিষয়টা আমাকে প্রথম ভাবিয়েছিল আমার কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার সময়। নগর সভ্যতা, নাগরিক কলকাতার ভাষা আমি বুঝিনা। আজও কি বুঝি? কে বলবে? এক সুচতুর ভাষা, সুচতুর সংস্কৃতি, চতুর কৌশলে নাগরিক সমাজের এক অংশ আমাদের মত ‘মাটি মাখা’ সরল মানবের মন দখল করতে চায়। পরে নিজেদের মত ব্যবহার করে। প্রথমে আমাদের মন পাচার হয়ে যায়। পরে দেহ পাচার হয়। এটাই সম্ভবত ‘মানব পাচার’ নামক সভ্যতা। এক কথিত এবং অকথিত আদিম সভ্যতা রমরমিয়ে ব্যবসা করছে। একুশ শতাব্দীর গতিশীল এক সমাজে। সাংবাদিকতার সুবাদে গত তিন দশক ধরে ‘শিশু শ্রমিক’ বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। কিন্তু একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে আমদের সামনে কালবৈশাখী ঝড়ের গতিতে অচেনা এক দানব আছড়ে পড়েছে। ‘মানব পাচার’ নামক আরও এক সভ্যতার অভিশাপ। মনে পড়ছে ২০০৪ সালে ‘জি নিউজ’-এর জেলার সাংবাদিক হিসেবে আমি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দায়িত্বে ছিলাম। সেই বছর আমি নারী পাচার, শিশু পাচার এবং শিশু শ্রমিক নিয়ে একাধিক খবর করেছি।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পঞ্চায়েতে ব্যপক দুর্নীতির খবর যেমন আমাদের করতে হয়েছে, পাশাপাশি চমকে উঠার মত বিষয় মানব পাচার। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি খবর করি। ৩ অক্টোবর, ২০০৪ সালে ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় খবরটি আরও বিস্তারিতভাবে লিখি। ‘নারীপাচার নিয়ে উদ্বেগে প্রশাসন’ শিরোনামে করা খবরের কিছুটা অংশ এখানে উল্লেখ করছি, ‘’......জিন্নাইদহ জেলার যশোর থানার কোরচানপুর পোস্ট অফিস এলাকার সবদলপুর গ্রামের মহঃ ফৈজল করিম মোল্লার বড় মেয়ে চক্রান্তের শিকার হয়ে কয়েকমাস মুম্বাইয়ের নিষিদ্ধপল্লীতে কাটাতে বাধ্য হয়। ওই মহিলা সমিতি মুম্বাইয়ের ১৮, গিরগাঁও কোর্টের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ফতিমাকে তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে চায়। সেই মত মহিলা সমিতির এক্সিকিউটিভ কমিটির এক সদস্য ভারতীয় বিদেশ দপ্তরে লিখিত অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধের ভিত্তিতে ভারতীয় বিদেশ দপ্তর কলকাতায় বাংলাদেশের উপ রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেনকে বিষয়টা জানায়। এ বিষয়ে তৌহিদ হোসেন জানান, ‘’আমরা ভারত সরকারের চিঠি পেয়েছি। এবং আমরা ফতিমার বাড়ির ঠিকানায় যোগাযোগও করেছি। সরকারি প্রক্রিয়া শেষ হলেই আমরা ফতিমাকে দেশে ফিরিয়ে নেব।‘’
সেই খবরকে আশ্রয় করে ২০১১ সালে আমাদের প্রেসক্লাবের স্যুভেনিয়রে ‘দুই কন্যার গল্প- যা গল্প হলেও সত্যি’ শিরোনামে আমার লেখায় ফতিমার বলা কথাগুলি উল্লেখ করি। এই লেখায় আবার উল্লেখ করতে চাইছি।
ফতিমা বিবির পদ্মা
ওর বয়স ১৯ না ২০ ও নিজেও জানে না। প্রশ্ন করলেই এক নদী ঢেউয়ের মত খিল খিল করে হেসে ওঠে ফতিমা। বলে, আমি কেমনে জানুম?
বাংলাদেশের খাল-বিল। নদ-নদী, গাছ-গাছালির সরলতা মাখা মুখ আমাকে বিহবল করে রেখেছে। টানা টানা চোখ। ধব ধবে ফর্সা। ফতিমাকে দেখে মনে হচ্ছে কত দিনের চেনা। তখনও মুম্বাইয়ের আরব সাগরের ক্লান্তি ওকে ছুঁতে পারেনি। নিজের কাজের কথা ভেবে সুন্দরের পূজা ভুলে অসুন্দরের খোঁজে ফিরি। জানতে চাই, ‘ফতিমা তুমি মুম্বাই কি করে গেলে?
নিরক্ষর ফতিমা বলে, ‘’বাড়িতে আমরা পাঁচ বোহিন। এক ভাই। আব্বা রিক্সা চালায়ে আমাগো সকলকে খাবার দিতে পারতেসিল না। মায় মোড়ল বাড়িতে কাম করে, তায় আর কি হয়? বাপটা একদিন আমারে দালালের কাছে বেঁচে দিলে। আমি জানতাম ওই লোকটা আমাকে নিকা করবে। বড় শহরে গিয়া বুঝলাম ঠগসি। আর কী করুম? কন?’’
‘এখন তুমি কি করবে?’
‘’আমি বাড়ি যাতি চাই। মাডাও চায় শুনসি। কিন্তু ওই মিনসা আমাগো বাপটা লইয়া যাইতেছে না। আমি কী করুম কনতো?’’
‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলনা—ও বাতাস আঁখি মেলনা’ গানটা এরকমই ছিল না?
ফতিমা এখনও সহজ সরল বাংলাদেশের মেয়ে। ওরা হারিয়ে কোথায় যাবে? এই সমাজ ওদের জায়গা করে দেয়। যতদূর জানি তৎকালীন বাংলাদেশের কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার তৌহিদ হোসেন নিজের উদ্যোগে ফতিমাকে বাংলাদেশের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তৌহিদ সাহেব আমায় বলেছিলেন, তিনি যেভাবেই হোক ফতিমার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন। ফতিমা বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিল জানি। কিন্তু তারপর?
তারপর ১৩টা বছর কেটে গেল। ফতিমাদের মত কত মেয়ের গল্প প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে। বিভিন্ন অসরকারি সংস্থা মানব কল্যাণে কাজ করছে। তাঁরাই চেষ্টা করছে মানব সভ্যতার এই অভিশপ্ত অধ্যায়ের সঙ্গে যুঝে ফতিমার মত আরও অনেক মেয়েকে বাবা-মা, দাদা-ভাই, নিজের সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দিতে। আমেরিকান সেন্টার সূত্রে খবর, সারা বিশ্বে মানব পাচারের ঘটনায় প্রতিহিংসামূলক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন সাধারন মানুষ।
হাতের কাছে একটি লেখা পাচ্ছি। ‘Human Trafficking in India must end’ শিরোনামে লেখাটি ৮ নভেম্বর রমণদীপ কাউর অনলাইন পত্রিকায় লেখেন,
‘’Human trafficking is one of the major problems in India. Till date no concrete study has been conducted so far to know the exact number of trafficked kids in India. The New York Times has reported on the widespread problem of human trafficking in India especially in the state of Jharkhand. Also in the report it is stated that young girls are trafficked from neighboring Nepal to India. In another article published in The Times of India – Karnataka is the third state in India for human trafficking. Other South Indian states are also the most sought after destinations for human trafficking. Every year more than 300 such cases are reported in each of the four south Indian states. Whereas West Bengal and Bihar, on an average have 100 such cases each year. As per the data, more than half of the human trafficking cases are from these states. According to the latest report on human trafficking by the United Nations Office on Drugs and Crime reveals that Tamil Nadu has 528 such cases of human trafficking in 2012. The number is really high and more than any other state except for West Bengal (549). As per the data from Home Ministry, 1379 cases of human trafficking were reported from Karnataka in the period of four years, in Tamil Nadu the number is 2,244 whereas Andhra Pradesh has 2,157 cases of human trafficking. Recently 300 bonded labourers in Bangalore have been rescued. According to an article in Firstpost, Delhi is the hub of human trafficking trade in India and half of the world’s slaves live in India. Delhi is the hotspot for illegal trade of young girls for domestic labour, forced marriage and prostitution. Delhi is also the transit point for human trafficking.’’
বিভিন সামাজিক সমস্যার মূলে পৌঁছে কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেল অফিস কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। ‘মানব পাচার’-এর বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সারা বছর ধরে ধারাবাহিক কর্মসূচী নিয়েছে কলকাতার আমেরিকান সেন্টার। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাসট্যাগ ব্যবহার করে ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা, পোষ্টার, ব্যানার মাধ্যমে প্রচার করে। পোষ্টারে লেখা ছিল,
# Kolkata TIP Conclave7
Myth: Sex trafficking affects only women, while labor trafficking affects only man.
O Fact: Both men and women can be victims of sex labor trafficking.
O Trafficking target vulnerable populations around the world.
O Traffickers do not discriminate; victims can be men, women, children, Citizens and non-Citizens alike, from all Socio-economic groups.
এদিন ছিল মানুষ পাচার রোধের একটি অনুষ্ঠান। শুক্রবার ২৭ এপ্রিল ‘Join us to strengthen the global fight against ‘Human Trafficking’, 7th anti-Trafficking in persons Conclave.’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। ব্যাতিক্রমী ছিল কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের এই অনুষ্ঠান। সমস্ত দিক থেকে।
সকাল থেকে শুরু হয়ে সারাদিন চলে কনক্লেভ। মানব পাচার কি করে বন্ধ করা যায়? সেই বিষয়ে আমেরিকান সেন্টারে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, রাজ্যের সরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘কনক্লেভ’-এ আলোচনা হয়। আমরা আমন্ত্রিত ছিলাম দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই পর্যায়ে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। ‘Not My Life’ নামে এই ধরণের তথ্যচিত্র আমি আগে দেখিনি। মূলত আফ্রিকার দু’তিনটি শহরকে তথ্যচিত্রে বেছে নিলেও পরিচালক রবার্ট বিল হেইমার আমাদের টানতে টানতে নিয়ে যান সমস্যার গভীরে। তথ্য পরিসংখ্যানে ভারাক্রান্ত না করে বাস্তবের ক্যানভাস সামনে আনেন রবার্ট। তিন থেকে চারজন নারীর ব্যক্তিগত জীবনে তিক্ত অভিঞ্জতার কথা তিনি শোনান। একজন পাচারকারীকে আমরা দেখি পুলিশ তার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিজেদের গাড়িতে তোলে। ‘Not my Life’ তথ্যচিত্রে এই দৃশ্য পরিচালক আমাদের সামনে বার কয়েক আনেন। আমরা জানতে পারি গ্রেপ্তার হওয়ার ব্যক্তির ৯৫ বছর কারাবাসের সাজা হয়েছে। অনবদ্য রবার্ট সাহেব। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। আপনার সাহস শুধু নয় আপনার মুন্সিয়ানা আপনার কথনে। আপনার চিত্রনাট্যের ভাষায়। ‘ক্যামেরার লেন্সে’। আমরা একটি ছবি থেকে নারী পাচারের গভীরে যেতে পারি। আমরা জানতাম পাচার হওয়া মেয়েদের পরিবারের দারিদ্রের কথা। আপনার তথ্যচিত্র থেকে জানতে পারি আরও বিস্তারিত। ওরা পাচার হয়ে কোথায় যায়! কিভাবে থাকে। পুলিশ চেষ্টা করলে পাচার হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মেয়েরা বিশ্বের কোন কুঠিতে আছে, সেটা বলতে পারে। সহজ সরল নিষ্পাপ মেয়েগুলিকে ফিরিয়ে দিতে পারে তাঁদের শৈশব, কৈশোর! মানুষ পাচার নিয়ে ‘উইকি পিডিয়া’ থেকে একটি অংশ উল্লেখ করা যাক।
Human trafficking in India, although illegal under Indian law, remains a significant problem. People are frequently illegally trafficked through India for the purposes of commercial sexual exploitation and forced/bonded labour. Although no reliable study of forced and bonded labour has been completed, NGOs[who?] estimate this problem affects[clarification needed] 20 to 65 million Indians. Men, women and children are trafficked in India for diverse reasons. Women and girls are trafficked within the country for the purposes of commercial sexual exploitation and forced marriage, especially in those areas where the sex ratio is highly skewed in favour of men. Men and boys are trafficked for the purposes of labour and may be sexually exploited by traffickers to serve as gigolos, massage experts, escorts, etc.[4][5] A significant portion of children are subjected to forced labour as factory workers, domestic servants, beggars, and agriculture workers, and have been used as armed combatants by some terrorist and insurgent groups.
India is also a destination for women and girls from Nepal and Bangladesh trafficked for the purpose of commercial sexual exploitation. Nepali children are also trafficked to India for forced labour in circus shows.[citation needed] Indian women are trafficked to the Middle East for commercial sexual exploitation. Indian migrants who migrate willingly every year to the Middle East and Europe for work as domestic servants and low-skilled labourers may also end up part of the human trafficking industry. In such cases, workers may have been 'recruited' by way of fraudulent recruitment practices that lead them directly into situations of forced labour, including debt bondage; in other cases, high debts incurred to pay recruitment fees leave them vulnerable to exploitation by unscrupulous employers in the destination countries, where some are subjected to conditions of involuntary servitude, including non-payment of wages, restrictions on movement, unlawful withholding of passports, and physical or sexual abuse.[6][unreliable source?]
Human trafficking in India results in women suffering from both mental and physical issues. Mental issues include disorders such as PTSD, depression and anxiety. The lack of control women have in trafficking increases their risk of suffering from mental disorders. Women who are forced into trafficking are at a higher risk for HIV, TB, and other STDs. Condoms are rarely used and therefore there is a higher risk for victims to suffer from an STD. Filmmaker Manish Harishankar highlights the issue of child trafficking in India in his thriller film Chaarfutiya Chhokare, showing the problem, nexus, modus operandi and repercussions. The thriller film Thira, directed by Vineet Srinivasan, also addresses human trafficking in India.
U.S. State Department's Office to Monitor and Combat Trafficking in Persons placed the country in "Tier 2" in 2017.[7] (WikiPedia) )
শুক্রবারের তথ্যচিত্রের শেষে ছিল লাইভ চ্যাট। প্রশ্ন উত্তরের পর্ব। পরিচালক রবার্ট বিলহেইমার নিউ ইয়র্ক শহরে বসে উত্তর দিলেন অনলাইনে। প্রশ্ন করলেন মডেল-অভিনেতা নন্দনা দেবসেন এবং আমেরিকান সেন্টারের প্রাণচঞ্চল ডিরেক্টর জেমি ড্রাগন। আমরা সেই আলোচনায় পরিচালকের বিভিন্ন অভিঞ্জতার কথা জানতে পারি। বিশেষত মানুষের দেহাংশ পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ করেন রবার্ট।
পরের অনুষ্ঠানটি ছিল আরও একধাপ ব্যতিক্রমী। ‘কলকাতা সংবেদ’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী আধুনিক ফর্মের বিপ্লবের নাচ (Dance for Revolution) দেখালেন। এবং আমাদের বলতে বাধ্য করলেন ‘Stop Human Trafficking’। কলকাতা সংবেদ নিজেদের নৃত্যনাট্যে বাংলার লোকশিল্পকে ধ্রুপদী ঘরানায় উপস্থাপনা করে বুঝিয়ে দিলেন, ইংরেজি এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ প্রজন্ম সামনের সারিতে এগিয়ে আসতে জানে। দলটি তাঁদের নাটকে পুরুলিয়ার ছৌনৃত্য এবং বাংলার পুতুল নাচকে মুন্সীয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছে।
শুক্রবারের শেষ অনুষ্ঠান ছিল মানব পাচার নিয়ে যারা সারা দেশে কাজ করছেন তাঁদের সম্মান জানানো। কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেল ক্রেগ হল তাঁদেরই কয়কেজনকে মেমেন্টো এবং সম্মানপত্র দিয়ে সংবর্ধিত করেন।
No comments:
Post a Comment