রাজপথ চিনতে চাই না জনপদে খুঁজে নেব তোমাকে:
একদিন কানের কাছে কেউ একজন ফিস ফিস করে প্রশ্ন করল ‘বেঁচে আছ তাহলে?’ উত্তর
দিতে চাইনি। পশু যদি বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা মুহূর্ত লড়াই করতে পারে। সেখানে
আমরা মানুষ। বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ। এক চোখে দেখ অথবা দু’কানে শুনতে পাও। রেলের খালাসিদের কাছে শোনা, ‘এই
ঠিকাদার বাবুর দাদুকে লিয়ে......’, ‘হেঁইয়ো’। ‘জোরসে মারো’। হেঁইয়ো।‘ ‘রেলবাবুর দু’কান কাটা’......’,
‘হেঁইয়ো’। এই আরও জোরে......’। ‘জোরসে বোলো......’। হেঁইয়ে......’। ‘মারকে
দিখাও......।’ ‘হেঁইয়ো......’ ‘রেলবাবু
টাকা ক্যনে কম দিছিস...’? ‘হেঁইয়ো’, হেঁইয়ো...। ‘রেল বাবুর টাঁকে চুল
গজালছে......’, ‘হেঁইয়ো, হেঁইয়ো...। রেলের খালাসিদের কঠোর কঠিন শ্রমের ‘রাগ’,
কষ্ট, শ্লাঘা, যন্ত্রণা, ঘাম, ঘামের ঘ্রাণ সব একাকার হয়ে যায় ওই ধরণের শ্লোগানে।
সর্দার হাঁকেন। চ্যালার দল দোহারার কাজ করে। আমরা কান দিয়ে শুনেছি। দু’চোখ দিয়ে
দেখেছি। না চোখ দিয়ে কোনদিন শুনিনি। কান দিয়ে দেখতেও চাইনি।
হ্যা সেই জনপদে তোমেকে পেয়েছিলাম। তুমি সেদিন বলতে
এই জনপদ দিয়ে যাব। এই জনপদে ধুতরো ফুল আছে। এই জনপদে ক্যাকটাস আছে। আঁতা ফলের
ঝোপঝাড় আছে। জবা ফুলের হাতছানি আছে। রক্তগাঁধা আছে। লজ্জাবতির বনলতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
চলে যাব। বনকুলের কাঁটা আছে। আমি এই পথ দিয়ে যাব। রাজপদ দিয়ে যেও না। রাজপথে গোলাপ
থাকে। থাক। গোলাপের সাজানো বাগান থাকে। আরে থাক না। চন্দ্রমল্লিকার সুঘ্রাণ থাকে।
তুমি বলেছিলে, থাক। থাকতে দাও না।
বনমল্লিকা কোথায় পাবে? বনফুল কোথায় পাবে। লজ্জাবতির বনলতা কোথায় পাবে? আমি ওই পথ
দিয়ে যাব। জনপদ দিয়ে যাব। রাজকুমারী ঘুমিয়ে থাকে। জনপদের রাজকন্যা খালাসি পাড়া
চেনে। আমি খালাসি পাড়ার পথ দিয়েই যাব। খালাসি পাড়ার পথ দেখে পথ চিনতে চিনতে একদিন
কলকাতায় রাজপথে এলাম। ‘শহরটার এই গোলক ধাঁধাঁয় আঁধার হোলো মন’। আমরা সকাল সকাল
কলকাতায় এলে হাওড়া স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে বড় বাজার হয়ে বই পাড়ায় আসতাম। তারপর
সেখান থেকে ট্রাম লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলকাতা তোমাকে দেখেছি। দেখেছি গাছেলা
মেয়েদের হাতছানিতে। দেখেছি কমললতার আড় চোখের চাহনিতে। কাজল পড়া বৌঠাকরুনদের ফিচেল
হাসিতে।
সেই রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়
এক গলিতে গেলাম। কানাইধর লেন। আমার ফুলদি থাকতেন। উচ্চ শিক্ষিত পরিবার। আমার নিজের
পিসির মেয়ে। জামাইবাবু সুধন বাগচি তৎকালে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হাইজিন’ নামক সংস্থায়
ডাইরেক্টরের পিএ ছিলেন। সন্ধ্যের ছুটির পর, রবিবার এবং অন্যান্য ছুটিরদিন তিনি আরও
একটি কাজ করতেন। প্রখ্যাত চর্মরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ রঞ্জিত পাঁজার চেম্বারে সহযোগী
হিসাবে কাজ করতেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সুধন বাগচী মানে আমার জামাইবাবু স্থায়ীভাবে
ডাঃ রঞ্জিত পাঁজার চেম্বারে আমৃত্যু কাজ করেছেন। আমার মনে আছে অজিতদা মানে অজিত পাঁজা যেদিন কেন্দ্রীয়
তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের মন্ত্রী হলেন আমরা তার পরেরদিন পাঁজাবাড়ী থেকে পাঠানো
বনেদি মিষ্টি খেলাম। পরে সাংবাদিক হিসাবে কলকাতা হাইকোর্টে অজিতদার একাধিকবার
সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তার অভিনীত নাটক ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’ নাটক সাংবাদিক হিসাবে
কভারেজ করেছি। নাটকও দেখেছি।
কলকাতা তোমাকে অভিনন্দন। তোমার রাজপথে যেদিন থেকে
এসে ঠাঁই নিলাম সেদিন থেকেই যে জনপদ ভুলে গেছি এমন বলাটা অর্বাচীনের ভাষা হয়ে যায়।
ফুলদির বাড়িতে থাকত আমার থেকে এক বছরের ছোট সুহাস বাগচী। সুহাসও হাইজিনে চাকরি
করত। তিন তলার ওই ফ্ল্যাটের একটি ঘর নিয়ে থাকত আরও একজন। মকবুল ফিদা হোসেনের মতো
লম্বা, কাঁধ পর্যন্ত বাবরি চুল। লম্বা দাড়ি। টিকালো নাক। অমল মণ্ডল। বেনিয়াটোলা
লেনে লেটার প্রেসের ব্যবসা ছিল। কবিতা লিখত। সাহিত্যের সবদলের মানুষজনের কাছে বড়
আপনারজন ছিল অমলদা। অমলদা তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ আমি জানি না। আমার জীবনের জনপদে
তুমি দীর্ঘ দীর্ঘতায় রয়ে গেছ। যেদিন সুতো ছিঁড়ে গেল তারপর এ পথ সে পথে তোমাকে এই
কলকাতা শহরের অলি গলিতে খুঁজেছি। সলেমনকে খোঁজার মত খুঁজেছি। তুমি কোথায়? আরও অনেক
কিছু বলতে হবে। যদি সেই সুযোগ আসে। তুমি আমাকে যেমন গভীর রাতের নেশাতুর ভাষায়
বলেছ। অম্লান আলোয় ভিজে ‘রাতভোর বৃষ্টি’-এর কথা শুনিয়েছ অন্যদের। তাদেরকে সেই
জনপদের মানুষগুলিকেও তুমি বলে গেছ, ‘দীপেন একদিন খুব বড় হবে। দেখে নিও।’ আশির দশক
আমাকে এঁকে দিয়েছে গদ্যের ছন্দে হেঁটে চলা। পদ্যের ছন্দে ‘ছাতিম’ গাছের নীচে
‘ধুতরো’ ফুলের স্পন্দন খুঁজতে খুঁজতে কলকাতার রাজপথে ছুটছিলাম। একটা বুড়ো অশ্বত্থ
হেসে আমাকে বললে, ‘ও পথে যাসনে। ওই পথ তুই চিনিস না। তোকে সকলে গালি দেবে। তুই
জনপদে চলে যা। জনপদ দিয়ে হেঁটে যা। ঘামে ভেজা মজদুরদের দেখতে পাবি। ঘামে ভেজা
ছাত্রদের বইয়ের পাতা উলটে দেখ, ‘রাজপথে’ কন্যেরা কথা কয় কিন্তু দেখা দেয় না। তোমার
ঘরে অমলদা এক কন্যেকে একবারই দেখেছিলাম। তুমি বলেছিলে ‘একমাত্র দীপেন বলেই আমি ওর
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।’ তিনি ‘রাজপথ’ থেকে এসছিলেন না জনপদ থেকে? আমি আজও জানি
না। তবে অমলদা আমার অনেক না বলা কথা আজ রয়ে গেল। আমি জানি তুমি ‘কফিহাউস’ থেকেই
‘অমলকান্তি’কে খুঁজছিলে। অজিতদা মানে অজিত পান্ডে তখন আমাদের টেবিলের উল্টোদিকে
চুটিয়ে আড্ডা দিতেন।
তারপরে আমার সেই অচেনা শহরের রাস্তাগুলো আরও বড়
রাজপথ হয়ে গেছে। ওই দিনের জনপদে আমি, অমলদা, সুসু (সুহাস বাগচী), অমলদার ভাই বাপী,
(বাপী তখন মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়ছে)। এবং আরও একজন। সেই জনের নাম আমার মনে নেই।
পার্থ বসু নামে এক কাউন্সিলারের বাড়ির পাশে তার বাড়ি। আমাদের এই টিমটার কাজ ছিল
পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত কলেজ স্কয়ারের উল্টোদিকের গলিতে আইবুড়ো গল্প করা। হাইজিন
অফিসটা যে গলিতে সেটা সম্ভবত সূর্য সেন স্ট্রীট বা মির্জাপুর স্ট্রীট। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা মেডিকাল কলেজ এই দুই প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালের মাঝের গলিতে
আমরা সন্ধ্যে থেকে রাত এগারটা বারটা পর্যন্ত দু’টো বেঞ্চ নিয়ে পুজোর ছুটি কাটাতাম।
পুজোর পাঁচ ছটা দিন ওই গলিতে ভিড় থিক থিক করত। কারণ কলেজ স্কয়ারের পূজো মণ্ডপ থেকে
বেড়নোর পথ হিসাবে সম্ভবত ওই গলি বেশি ব্যবহার হত। সন্ধ্যের সময় আমাদের মতো জোয়ানমদ্দদের চোখ যেমন হয়
আরকি। ‘হেঁইয়ো...’। কিন্তু যারা কলেজ স্কয়ারের ঠাকুর
দেখে ,মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখতে যেত সেইসব মেয়েবেলার পটলচেরা চোখে তখন থই থই
উৎসবের চপলতা। তাঁদের কারো আমাদের দেখার ফুরসত নেই। ভিড়ের মাঝে ঘটত অন্য ঘটনা।
কয়েক জোড়া করে চটি জুতো কেউ না কেউ ফেলে চলে যেত। আমরা সেই চটি জুতো ছোট লাঠি দিয়ে
টেনে বেঞ্চের তলায় সরিয়ে রাখতাম। পরে যারা খুঁজতে আসত একজোড়ার জন্য নেওয়া হত দশ
টাকা। এক পাটির জন্য পাঁচ টাকা। মেয়ে ছেলে যারই হোক না কেন? দর্শনার্থীদের অনেকে
জেনে গিয়েছিলেন। চটি জুতো হারালে আমাদের কাছে পাওয়া যেতে পারে। তাই অনেকেই আমাদের
কাছে খোঁজ নিতে আসত। পায়ে গলিয়ে নিজেরটা মিলে গেলে টাকা দিয়ে জুতো নিয়ে যেত।
প্রতিদিন কমবেশি তিনশ টাকা থেকে পাঁচশো টাকা সংগ্রহ হত। ওই সংগৃহীত অর্থ দিয়ে আমরা
পাশের বস্তির ছেলেমেয়েদের স্কুলের বই, খাতা কিনে দিতাম। কালী পুজোর সময় বাজি পটকা
কিনে দিতাম। কোনও সময় অসুস্থ রুগীর ওষুধ কিনে দেওয়া হয়েছে। সবটা আমরা অত্যন্ত
গোপনে করতাম। কোনও রকম রাজনৈতিক রঙ যাতে না লাগে। আমি সেই সময় বলতাম হ্যা আমি জনপদ
দিয়ে যাব। তোমার কথা আজও শুনছি। এই পথে ধুতরো ফুল আছে। এই পথে বনকুল আছে। লজ্জাবতি
লতাগাছ পাওয়া যায়। এই পথে রাজলক্ষী আছে। এই পথে অন্নদাদি আছেন।
জনপদে হাঁটতে হাঁটতে যেদিন কলকাতার কানাইধর লেনে
গেলাম। প্রথমদিন দেখেছিলাম সুধন জামাইবাবু শ্রীম কথিত ‘কথামৃত’ পড়ছেন। মাঝে মাঝেই
তাঁকে এই বই পড়তে দেখেছি। জামাইবাবু একদিন ‘কথামৃত’ পড়ার সময় আমাকে একটা অংশ পড়ে
দেখতে বললেন। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।। বিলাতে কাঞ্চনের পূজা— জিবনের উদ্দেশ্য কর্ম না
ঈশ্বরলাভ? এই পরিচ্ছদের একটা অংশ ছিলো, ‘’তাই বলছি যে যা কিছু কর না কেন, এগিয়ে
গেলে আরও ভালো জিনিস পাবে। একটু জপ ক’রে উদ্দীপনা হ’য়েছে বলে মনে করো না, যা হবার
তা হয়ে গেছে। কর্ম কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য নয়। আরও এগোও, কর্ম নিষ্কাম ক’রতে
পারবে। তবে, নিষ্কাম কর্ম বড় কঠিন, তাই ভক্তি ক’রে ব্যকুল হ’য়ে তাঁকে প্রার্থনা
কর, ‘হে ঈশ্বর, তোমার পাদ পদ্মে ভক্তি দাও, আর কর্ম কমিয়ে দাও; আর যেটুকু রাখবে,
সেটুকু যেন নিষ্কাম হ’য়ে ক’রতে পারি।‘’
ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। অভাবে হোক বা স্বভাবে
হোক বাঙালি কি বড় বেশি কাম চোর? এক বাঙালির কথা আজ মনে পড়ছে। তিনি ক্ষিতিমোহন সেন।
প্রাচীন ভারতের যে শিক্ষা সেই শিক্ষায় ক্ষিতিমোহন তার প্রঞ্জায় আমাদের হাঁটতে
বলেছেন। উদার ঞ্জানের পথে। অর্ধশতক
জুড়ে তার আহরিত ঞ্জান দিয়ে আমাদের আলোকিত করেছেন। ক্ষিতিমোহন সেনের চর্চার বিষয়
ছিল মধ্যযুগের সন্তদের জীবন এবং বানী। কবীর, দাদূ নামক সন্তদের সাধনার বিষয়গুলির
মর্মে ঢুকে অনুসন্ধান করেছিলেন তিনি। বাউল সংগীত নিয়েও তিনি গভীর চর্চা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে ১৯০৮ সালে ক্ষিতিমোহন সেন চম্বা রাজ্যের কাজ ছেড়ে দায়িত্ব নিলেন বিশবভারতীর
অধ্যাপকের। বিশ্বভারতীর ব্রহ্মাচর্যাশ্রমে অধ্যাপনার কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন তিনি।
বহু ভাষাবিদ ক্ষিতিমোহন সেন ইংরাজি, বাংলা ছাড়াও হিন্দী এবং গুজরাটি ভাষায় একাধিক
বই লিখেছেন।
১৯৪৬ সালের একটি প্রবন্ধে ক্ষিতিমোহন লিখছেন, ‘’কত
কত সংস্কৃতিই এইভাবে ভারতের ধর্মের মধ্যে সমন্বিত হতে লাগল। ভারত তাই চিরদিন সবার
প্রতি উদার। ভারতে যখন যে ধর্ম বিপ্নন হয়ে আশ্রয় চেয়েছে, সে-ই আশ্রয় পেয়েছে।
যুদ্ধে জয়ী হয়ে আসবার কোন প্রয়োজন ঘটে নি। অভ্যাগতেরা আপন আপন ধর্ম ও সংস্কার নিয়ে
ভারতে অবিরোধে সাধনা করার অধিকার পেয়েছে। খৃস্টীয় প্রথম শতকেই দক্ষিণ ভারতে সিরীয়
(Syrian) খৃস্টানেরা আসেন। তাঁরা সেখানে সাদরে গৃহীত হন ও রাজাদের ভূমিদান লাভ করেন।
বিপন্ন পারসীরা গুজরাতে সাদরে অভিনন্দিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। রাজ্য জয় করবার পূর্বেই মুসলমান সব সাধক ভারতে এসে আতিথ্য ও সাধনার জন্য স্থানলাভ
করেন। তার পরে আসে মুসলমান সৈন্য। তেজপাল বস্তুপালের সময়ে গুজরাতের অনুপমা দেবী
মুসলমানদের জন্য আশীটি মসজিদ করে দেন। বিজয়ী মুসলমানদের জন্য সে মসজিদ নহে।‘’
এখন পথ চিনে যেতে পারব। তুমি যে জনপদ দিয়ে আমাকে
হেঁটে যেতে বলেছ সেই পথে আলো আছে। সেই পথে জোনাক জ্বলে। ভালোবাসার মশাল জ্বলে।
রাতপোকারাও অজান্তে বন্ধু হয়ে যায়। রাতপাখিদের সঙ্গে সখ্য করে নেওয়া যায়। কেন?
বলব? হুতোম আমার চির সখা চির বন্ধু হয় যে। এসো আজ থেকে আমরা জনপদ দিয়ে হাঁটি।
No comments:
Post a Comment