Thursday, 10 November 2016

নীল সাগরের ঢেউ

নীল সাগরের ঢেউ
এভাবে কি বলা যায়? ঠাকুরও দেখলাম কলাও বেচলাম? বললে সবই বলা যায়। আবার না বললেও হয়। আমি বা আমরা নিজের নাম মনে রাখতে কেন চাই? নীল সাগরের ঢেউ গোনার জন্য? সাত সকালের ঢেউ গুনতে যতটা ভালো লাগে, তার থেকেও বেশি ভালো লাগে ‘বেলা শেষের’ সাঁঝ বেলার ঢেউ। সেদিন দেখে এলাম সেই বেলা শেষের মঞ্চ কবিতা। দু’টি মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল আশাবাদের ঢেউয়ের গল্প বলতে বলতে। ঠিক ঠাক বললে কলা বেচা নয়আবার ঠাকুর দেখাও নয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার ‘জীবিকা ও জীবনসংস্কৃতি’ বিশেষ সংখ্যা (জুলাই-সেটেম্বর, ২০১৬, ৩৭৬ পৃষ্ঠা), এই সংখ্যায় ‘বাংলার রঙ্গমঞ্চে পঞ্চ কন্যার পথ চলা’ এই শিরোনামে আমার একটি লেখা আছে। সেই লেখার অন্যতম একজন কন্যা বর্তমান সময়ের ব্যস্ততম ‘নাট্যব্যক্তিত্ব’ রঙরূপ গোষ্ঠীর সীমা মুখোপাধ্যয়। পত্রিকা সম্পাদকের অনুরোধমত পত্রিকার সংখ্যাটি সীমা মুখোপাধ্যায়কে ‘অ্যাকাডেমি’তে দিতে গিয়ে জানতে পারলাম বুধবার ( নভেম্বর ৯, ২০১৬) রঙরূপ প্রযোজিত সীমা মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘তখন বিকেল’ নাটক অভিনীত হবে ‘অতিথি’র অধিকারে ঢুকে পড়লাম প্রেক্ষাগৃহে।  
নাটক শুরুর সময় যত এগিয়ে এল প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি হয়ে গেল। দু’জন পরিচিত নাট্য ব্যক্তিত্বকে চিনতে পারলাম। একজন সোহাগ সেন। অন্যজন মেঘনাথ ভট্টাচার্য। আমি নাটক দেখার সুযোগ পাইনি ‘কুড়ি কুড়ি’ বছর। তাই ‘নাগরিক কলকাতা’ কেমন যেন এখন অচেনা লাগে। কিন্তু নাটকের বিষয় আর মাত্র একজন অভিনেতা এবং একজন অভিনেত্রীর ‘কাব্যিক’ দাপটে আমাদের মত গেঁয়ো দর্শকদের অন্য কোনও চোখ খোলা ছিল না। তাই এক চোখেই আবিষ্ট হয়ে নাটক দেখলাম।   
মূল নাটকটি অ্যালেক্সি আর বুজড (ওল্ড ওয়ার্ল্ড) এর লেখা। বাংলা রূপান্তর করেছেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। নাটকের মূল ধরতাই ‘বেলা শেষে’র ঢেউ গুনছি মানে এই নয় যে আমরা ফুরিয়েছি’। জীবন কিন্তু তা নয়। জীবনে ঢেউ, ছন্দ, তাল, লয় সব যেন প্রতিদিন নতুন করে উচ্চারণ করা যায়। নাটক দেখে তেমনই এক আলোকিত নূপুরের শব্দ শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরলাম।
আগেই বললাম নাটকের দু’টি চরিত্র। ডঃ পার্থ সান্যাল আর ‘অদ্ভুত পেশেন্ট’ উমা রায়। এই দু’ই চরিত্রকে নিয়ে মাত্র পঁচিশদিনের সংলাপ আমাদের মনকে জাপ্টে ধরে রাখে। এই দু’ই ভিন্নধর্মী চরিত্রের অন্তরঙ্গ সংলাপের বুননে আমরা পেলাম ‘তখন বিকেল’ নাটক। স্যানিটেরিয়ামের প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে খান খান করে বেড়িয়ে আসে উমা নামের সীমা মুখোপাধ্যায়। নিজের মত করে নিজের ভাষায় সে গড়তে চায় জগতপুরনো গান, কবিতা নতুন নতুন উচ্চারণে ফিরিয়ে আনে উমা। স্যানেটেরিয়ামে আসার ছ’সাত দিনের মধ্যে উমার ডাক পড়ে ডঃ সান্যালের চেম্বারে। বিচিত্র কিছু অভিযোগ রয়েছে উমার নামে। এই চেম্বার থেকেই ডঃ সান্যাল চরিত্রের বিমল চক্রবর্তী এবং উমা চরিত্রের বিশিষ্ট অভিনেত্রী আমাদের ছুটিয়ে নিয় যায়। জীবনের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ় বেলার বিভিন্ন সব অভিঞ্জতা আমরা দু’ঘণ্টা প্রেক্ষাগৃহে বসে আপ্লুত হয়ে রইলাম। এই নাটক দেখার পর নাট্য নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়কে বর্তমানের একজন শ্রেষ্ঠ নির্দেশক বলেই মনে হল। পাশাপাশি তাঁর অভিনয় আমাদের বলতে বাধ্য করে তিনি এই সময়ের ‘তখন বিকেল’ এই শব্দ বন্ধকে উপেক্ষা করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন অন্যতম অভিনেত্রী হিসবে। ডঃ সান্যালের চরিত্রে বিমল চক্রবর্তীকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কত চেনা আমদের। সীমার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েই তাঁকে মঞ্চে দু’ঘণ্টা পাই আমরা।
উৎপল দত্ত সম্পাদিত ‘এপিক থিয়েটার’ বিশেষ সংখ্যা (১৯৮১)য় ‘যা দেখেছি তা দেখাব’ শিরোনামে মন্মথ রায় লিখছেন, ‘’বার্টলট ব্রেশট সেই লোক যিনি তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেনঃ আমি একজন নাট্যকার যা দেখেছি আমি তাই-ই দেখাব। আমি দেখেছি মানুষের হাটে কেমন ক’রে মনুষ্যত্বের ব্যবসা চলে। আমি তা দেখাব।‘’

‘তখন বিকেল’ নাটকের নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায় তাঁর কলমে লিখছেন, ‘’মোহিতদার নাটকে একটা সংবেদী কাব্য আছে। যত পড়ি ততই যেন ঘোর লেগে থাকে .........নাটক শুনেই মনের মধ্যে অনেক ছবি ভাসতে থাকে, তারপর সেইগুলিকে জুড়ে তৈরি হয় মঞ্চরূপ। গান্ধারের ‘তখন বিকেল’ আমি দেখেছি। ............ছুটতে থাকা সমকাল, দস্যু সময়, ভালবাসাহীন চারপাশ, দশ আঙ্গুলের ফাঁক গলে যাওয়া সম্পর্ক এসবের মাঝে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দুটি মানুষ জড়িয়ে পড়েছে নতুন সম্পর্কে; স্বপ্ন দেখছে, দেখাচ্ছে। মুক্তির আলোয় ভাসছে।‘’                                                        

No comments:

Post a Comment