আভিজাত্যের পরম্পরা
কেউ কেউ বলে কম কথা
বললে আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলে কথা তো বলার জন্যই। তাই কথা বলতে
হয়। আবার অনেকে আছে কথা বলার কৌশলটা রপ্ত না করেই আভিজাত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে
বসে। কিছুটা অতি চালাকির আড়ালে নিজেদের অগ্রগামী ভেবে বসে। এদের বিষয়ে ভাবতে নেই।
ভাবলেই ‘কলাভাব’ প্রশ্রয়ে আত্মবিকার করে। একটা সময় এই ধরণের ব্যক্তিদের আড়ালে
আবডালে ‘মহারাজ’ বলে ডাকা হত। ‘মহারাজ’ শব্দটির ব্যপ্তি ব্যপক। কোনও পরিবারে
পুত্রকে অধিক গুরুত্বের কারণে ‘মহারাজ’ নামকরণ করা হত। আবার কলকাতা শহরে ভিন রাজ্য
থেকে আসা পাচকদেরও অনেক সময় সম্মানপূর্বক ‘মহারজ’ বলা হত। গ্রামের
তথাকথিত আভিজাত্য আছড়ে পড়ে আবার কখনও শহরের অচেনা আভিজাত্য চাবুক চালায়। এই লেখায়
এমন কিছু অভিঞ্জতার চয়ন করতে চাইছি। আমরা তার থেকে ‘মানবতার’ অভিনয় করা কিছু
ব্যক্তিক আচরণ খুঁজে পেতে পারি। একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক। তাঁর কাগজ থেকে কোনও
সাংবাদিক, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখক, প্রবীণ গায়ক, শিল্পীদের কাছে সাক্ষাৎকার নিতে
গেলে তাঁরা বলতেন, ‘’ও... অমুকের কাগজ থেকে এসেছ? না আমি ওই ভদ্রলোকের কাগজে কোনও
সাক্ষাৎকার দেব না।‘’ সাংবাদিক জানতে চাইত কেন? দেবেন না কেন? উত্তরে প্রবীণ
শিল্পীরা বলতেন, ‘’ওর সঙ্গে কাজ করা অতীত অভিঞ্জতা ভালো নয়। শিল্পীদের সঙ্গে
সম্পাদক ভদ্রলোক সংবাদ পত্রের সামাজিক শর্ত
উপেক্ষা করেন। তাই কি প্রয়োজন? অকারণে আমদের মত সংবেদনশীল ব্যক্তিদের অপমান
সহ্য করার।‘’ উল্লেখিত পত্রিকার
সাংবাদিকের কাছ থেকে এরকমটা শোনা যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা কমলের
পাড়ার এক দাদার কাছ থেকে শোনা। সালটা ১৯৬৯-৭০। অগ্নিগর্ভ বাংলা। ভদ্রলোকের নাম
একটা ঠিক করে নেওয়া যাক। সনাতন ফুলহার। তপসিলি জাতি। সনাতনবাবু তাঁদের অঞ্চলে
প্রথম ওই সম্প্রদায় থেকে স্নাতক। সেই সময় ভদ্রলোক তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের
খুব কাছের বাধ্য ছাত্র ছিলেন। সেই শিক্ষক মহাশয় উচ্চ শিক্ষিত। অকৃতদার। সংস্কৃতি সম্পন্ন।
অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি একটি চিঠি লিখে তাঁর কলকাতার বাড়িতে সনাতনবাবুকে পাঠিয়েছিলেন। সনাতনবাবুর বাবার সরকারি অফিসের কলকাতায়
কিছু কাজ ছিল। তখনকার সময়ের হাড় কাঁপান পৌষ মাসের শীতে কলকাতায় এসেছিলেন সনাতনবাবু। শিশির ভেজা শীতকাল। নিজের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে অত্যন্ত সঙ্কোচ নিয়ে
ছিলেন। গ্রাম্য সরলতা এবং তৎকালীন নিম্ন জাতের দ্বিধা নিয়ে কলকাতার এক অভিজাত
বাড়িতে কয়েকদিন ছিলেন। খাওয়া নিয়ে তাঁর অভিযোগ ছিল না। কারণ পেট ভর্তি খাবার না
পেলেও বাইরে থেকে তিনি খেয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তাঁকে রাত্রে শুতে দেওয়া হত দোতলা বাড়ির রাস্তার দিকের ঝুল
বারান্দায়। খস খস দিয়ে বারান্দার খোলা অংশ ঢেকে দেওয়া থাকলেও পৌষের শীতের উথাল
পাথাল কনকনে হাওয়া হিস হিস শব্দে চাবুক মারত। কারন বিছানা বলতে একটা শতরঞ্চি। বাড়ি
থেকে আনা নিজের খদ্দরের চাদর দিয়ে সেই শীত কি আটকান যায়? তবু তিনি থাকতে বাধ্য
হয়েছিলেন দারিদ্রের কারণে। হোটেলে থাকার সামর্থ ছিল না। কলকাতার কাজ করে অসুস্থ
হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। প্রগতিশীল পরিবার। তাঁদের মানবতা চিনে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।
এর পরের অভিঞ্জতা কমলের নিজের। কমলও তপসিলি সম্প্রদায়ের। বামপন্থী
আন্দোলনের কর্মী। কম বেশি প্রায় আট বছর জেল খেটেছে। জেল থেকে বেড়িয়ে আশির দশকে
রাজনৈতিক মতাদর্শগত গোষ্ঠী কোন্দল দেখে বাড়িতে চুপ করে বসেই ছিল। অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু
ছেলে। নিজেদের গ্রাম থেকে গঞ্জ শহর আস্তে হত পায়ে হেঁটে। প্রায় ৮ মাইল হেঁটে আসতে
হত। সেই কমল কলকাতায় এল দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক কর্মী হয়ে। এক বিপ্লবী নেতা ওকে
কলকাতায় নিয়ে এলেন তাঁর দলের রাজনীতি করার জন্য। ওকে মধ্য কলকাতার যে ঘরে থাকতে
দেওয়া হল সেই ঘরে দিনের বেলায় সূর্যের আলো আসত না। সেটাও ঠিক আছে। কমল অত উচ্চ
শিক্ষিত নয় যে দিনের বেলায় ‘বাবুশিক্ষা’র প্রয়োজনে খবরের কাগজ পড়তে হবে। তবে
রাজনৈতিক খবর জানার জন্য খবরের কাগজ পড়তে হত। কমল নিজেকে ‘ডাকহরকরা’ বলতে ভালবাসে।
কারণ নিজের গ্রাম থেকে গঞ্জ শহর আসত প্রায় ৮ মেইল পায়ে হেঁটে। তখন খবরের কাগজটাও
পড়ে বাড়ি ফিরতো। মধ্য কলকাতার যে ঘরে ও ছিল আলো না এলে কি হবে? ওর কথায় ‘শিয়ালদা
স্টেশনে বসে কাগজ পড়ি লিতাম’। কিন্তু কমলের রাতে শোওয়ার অভিঞ্জতা। ওর ভাষায়। ‘শুন তাহলে কমলবাবু কলকাতায় এলেন। বিপ্লব করতে। জেল খেটি বুঝে লায় এসব বিপ্লব এখন হবার লয়। তা
কলকাতায় এলে। গাঁ গঞ্জে হাফশোল হয়ে যাওয়া লাইফ লিয়ে যারা ‘বিপ্লব’ এর কথা ভাবছিল, অরা
বুলবে গাঁয়ের ছেলা ‘কমল’ কলকাতায় রাজনীতি করে। মজা পেছিস? পেছিস কিনা বুল? আমি
কলকাতায় থাকি যে ঘরে, ওই ঘরে গাঁয়ের জোতদারদের বাড়িঘরে যেমন ছেলা মেয়া লিঙ শুবার
খাট থাকে, ওই রকম সাইজের একখান বড় টেবিল ছিল। একবছর কুনো বিছানা ছাড়া ওই টেবিলে
শুয়াছি। মাথার বালিশ জেলেও ছিল না। তাই অভ্যেস হুঙ গেলছিল। খবরের কাগজ মাথায় দিঙ
শুয়াছি। আমাদের দলের বাবুরা কিন্তু মস্ত পণ্ডিত। গরিব মানুষের জন্যই অরা সবাই ভাবে
বুল? কত ঞ্জান উয়াদের। উয়াদের ঞ্জানের ‘গজদন্ত’ আছে। সব্বাই এক্কেবারে দয়ার
রাজহাঁস।‘’ আমি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম হাসব না কাঁদব?
আমাদের সঙ্গে আছেন জর্জদা। জর্জ দেবব্রত বিশ্বাস। ২০১১ সালে ২২শে অগস্ট
তাঁর জন্ম শতবর্ষ হয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে তাঁর নিজের লেখা আত্মজীবনী ‘ব্রাত্যজনের
রুদ্ধসংগীত’ বই প্রকাশ হয়। মুখবন্ধে জর্জ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘’আমার মনে আছে আমি
জন্মেছিলাম ম্লেচ্ছ হয়ে— শেষজীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে হয়ে গেলাম ‘হরিজন’’। ১৪ বছর
পিছনে হেঁটে যাই। সালটা ১৯৭৪ এর ১৪ এপ্রিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘স-ক-ঘ’ (সন্তোষ
কুমার ঘোষ) একটি প্রতিবেদন লিখলেন। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘কার গান? কার সুর?’
বিষয় অবশ্যই দেবব্রত বিশ্বাস। সন্তোষবাবু প্রশ্ন তুলেছিলেন দেবব্রতের গায়কি নিয়ে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পরে পরেই গায়কের অনুরাগী মহল গর্জে উঠলেন। প্রিয় সঙ্গীত
শিল্পীর সমর্থনে পত্রিকার দপ্তরে আছড়ে পড়ল প্রতিবাদের ঢেউ। এই ঘটনার পর যুগান্তর
পত্রিকায় ২৫শে মার্চ, ১৯৭৫ সালে ‘বিশ্বভারতীর খামখেয়ালিপনা’ শিরোনামে প্রতিবেদন
প্রকাশ হল। প্রতিবেদনে বিশ্বভারতীর কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করা হয়। এবং কতৃপক্ষ
যে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধেও প্রতিবেদক সোচ্চার হন। এর
পরের ইতিহাস আমরা জানি।
‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ গ্রন্থে দেবব্রত বিশ্বাস মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখলেন,
‘’আমি ১৯৭০-৭১ সনের পরে আর কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করিনি এবং আমার মনে হয়
ভবিষ্যতে আর হয়তো রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করবার সুযোগ আমার হবে না। মনে খুব আশা
নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, হয়তো বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি আমার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল
হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রকেই আমার রেকর্ড অনুমোদন করার দায়িত্ব দেবেন। কিন্তু
হঠাত একটি মর্মান্তিক দুঃসংবাদ পেলাম যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আমাদের বটুক, ২৫ অক্টোবর,
১৯৭৭ তারিখে আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরলোকে চলে গেল। বটুক চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও
পথে বসিয়ে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে আমি হয়ে গিয়েছিলাম ‘হরিজন,’ সেই হরিজন
হয়েই আমার জীবনের শেষ কয়টি দিন কাটাতে হবে।‘’
এখানেই বা থামব কেন? বাংলার রেনেসাঁ যুগের এক মহীয়সী নারীকে আমরা জানি।
তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চকে আলোকিত করেছিলেন নিজের ব্যক্তিত্বগুণে। তিনি নটী বিনোদনী
তথা বিনোদিনী দাসী। কিন্তু স্বীকৃতি? বিনোদিনী
সামাজিক স্বীকৃতি কতটা পেয়েছিলেন? তুলনামূলকভাবে বিচার করলে দেখা যায় ভিন্ন
মাত্রার ছবি পাচ্ছি আমরা। আভিজাত্যের ক্যানভাসে। ভিন্ন প্রেক্ষাপটের আঙ্গিকে নাগরিক সভ্যতার স্বীকৃত
মহানায়িকা বলেই কি তাঁদের ত্যাগের এত মর্যাদা? সে ভারতে হোক বা আমেরিকায়। যদিও
তাঁরা দু’জনের কেউ নাটক থেকে আসেননি। দু’জন মহান শিল্পীই আমার এবং আমাদের কাছে
ব্যক্তিত্ব, অভিনয়গুণে চিরস্থায়ী হয়ে আছেন এবং থাকবেন। বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অভিনয় জীবনের যে উচ্চতায় নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, সেই
উচ্চতা, মর্যাদা আজ পর্যন্ত কোনও বাঙালি বা ভারতীয় অভিনেত্রী পেয়েছেন বলে জানা
নেই। অভিনয় জীবনের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও এক লহমায় ফ্লাশ বাল্বের আলোকে ভ্রুকুটি
দেখিয়ে হেলায় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে অন্তপুরবাসিনী হয়ে রইলেন। আর সেটাই সুচিত্রা সেনকে
আরও মহান করে রেখেছে। অভিজাত বাঙালির চায়ের আড্ডায়, দুপুরের ভাত খাওয়ার টেবিলে।
ভারতীয় সিনেমার সমালোচকরা সুচিত্রা সেনকে হলিউডের গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে তুলনা
করেন। নাগরিক সভ্যতায় নাগরিক সংস্কৃতি বারে বারে একাধিক বার ওদের দু’জনের জন্মদিনে
আলোচনা করে। সংবাদ মাধ্যম তাঁদের ‘লালিপপ’ পাতায় আভিজাত্যের রঙ্গিন আঁচড়ে রঙ্গিন
পাতায় প্যাকেজ তৈরি করে আমাদের মনে করিয়ে দেয় অভিজাত দু’ই নারীর আত্মত্যাগ। কিন্তু পাঠক একবার ফিরে চলুন
উনবিংশ শতাব্দীর রঙ্গালয়ে। গিরীশ ঘোষের আভিজাত্যে যে নারী আজও চুপি চুপি জানান দিচ্ছে যে তিনিও ত্যাগ
করেছিলেন ভারতীয় তথা বাংলার রঙ্গমঞ্চের জন্য। তাঁকে বার দুয়ারের নারী বলে নাগরিক
সভ্যতা উদাসীন থাকলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। সেই মহীয়সী মহিলা একটা দু’টো
বছর নয়। দশ বিশ বছর নয়। ৫৫ বছর বিনোদিনী নাটক দেখেছেন দর্শক আসন থেকে। কিন্তু
ব্যথাভরা অভিমান থেকে আর বাংলা রঙ্গমঞ্চে ফিরে আসেননি। তিনি বিনোদিনী দাসী। মাত্র
১২ বছর নাটক করে বিনোদিনী জনপ্রিয়তার পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলেন। তাঁর খ্যাতি যখন
মধ্য গগনে তখনই নাগরিক সভ্যতাকে কঠোরভাবে বার্তা দিয়েছিলেন, আমি সেই নারী। তোমাদের
পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম কানুনকে মানি না। আমার অভিনেত্রীর মর্যাদা
চাই। নারীর মর্যাদা চাই। এই অভিমান থেকেই কি বিনোদিনী নিজেকে সন্তর্পণে সরিয়ে
নিয়েছিলেন? না তিনি সুচিত্রা সেন বা গ্রেটা গার্বোর মত স্থায়ীভাবে সরে যাননি।
সুদীর্ঘ ৫৫ বছর বাংলা রঙ্গমঞ্চের সামনে বসে দর্শকের ভূমিকায় সহ-শিল্পীদের মনে
করিয়ে দিয়েছেন আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমাদের সংগ্রামে আছি। তোমাদের দুঃখে থাকব।
কিন্তু আর নাট্যমঞ্চে নয়। বিনোদিনী আর নাটক বা পালা করলেন না।
কথাতো বলার জন্যই। শালীনতা রেখে। সামাজিক ভারসাম্য চিনে এবং সম্পাদকের
অনুমোদন নিয়ে সব ধরণের লেখাই লেখা যায়। আগন্তুক শব্দের মিছিল ভেঙ্গে প্রান্তিক
বাক্য গঠন কি সহজ? আশির দশকের প্রথম প্রহর। দ্বিতীয় প্রহর। তৃতীয় প্রহরে চেনা, জানা
এবং বন্ধুত্ব। এক ‘হোর্ডিং পেন্টার’ এর সঙ্গে। আমরা মধ্য কলকাতার একটি মেসে এক
সঙ্গে থাকতাম। সেই সময়ের কলকাতা। ঝুঁকিপূর্ণ হোর্ডিং। পুরনো দিনের বাড়ির তিনতলা চারতলার কার্নিশে বাঁশ বেঁধে
সেইসব বোর্ডে কাজ করতে হত তখনকার পেন্টারদের। আমার সেই আবেগ প্রবণ বন্ধুটিও
নিদারুণ কষ্ট করে কাজ করত। বার মাসে তের দাগের অসুখ নিয়ে সে কাজ করত। প্রখর রোদ,
অবিশ্রান্ত বর্ষা সব ঋতুতে মালিকের হুকুম মেনে কাজ করতে যেত। সন্ধ্যের পর ক্লান্ত শরীরটা
টেনে নিয়ে যেত সরকারি আর্ট কলেজের
বারান্দায়। নাইট কলেজ। অক্লান্ত শ্রম তাঁর আবেগকে চাগিয়ে দিত।
এখন আর সেই সব দিনের হোর্ডিং কোথায়? ঝুঁকির কাজও আজ আর নেই। পেন্টেড
ফ্লেক্স, পেন্টেড ফেস, পেন্টেড গ্লাস। আশি নব্বই দশকের সেই হোর্ডিং পেন্টারকে
‘দেশ’ পত্রিকা চিনিয়েছিলাম। রাম কিঙ্কর বেজ সহ একাধিক শিল্পীর নাম মন্ত্রের মত
উচ্চারণ করতে বলতাম। শিল্পী পরিতোষ সেনের ‘জিন্দাবাহার’ সহ একাধিক বই পড়তে দিয়েছিলাম।
সেই বন্ধুর ক্যানভাসে আঁকা ছবি নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী(‘এক্সিবিশন’) আমাকেই সব
ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তারও আগে ফরাসী কনসাল জেনারেলে গিয়ে ছবি বিক্রি। সেও আমাকে করতে হয়েছিল। প্রথম সারির একটি
ইংরেজি দৈনিকে ‘পেস্টআপ’ বিভাগে চাকরি। সেটাও পাকা ব্যবস্থা করার জন্য আড়াল থেকে আমাকেই এগিয়ে আসতে হয়। তখনকার সেই হোর্ডিং পেন্টারকে
আভিজাত্য চেনাতে হয়েছিল। আভিজাত্যের উঠনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর? আভিজাত্যের জঙ্গলে
হাবুডুবু খাচ্ছে কি সে? সুযোগ পেলে জানা যাবে। জানানো যাবে ১/৮ ডিমাই সাইজের
দু’একটি অধ্যায়ের বয়ান। রঙ তুলি হাতে।
আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘আমাদের তুমুল হৈ হল্লা’
নামে একটি কবিতার বই আমাকে উপহার দিয়েছিল। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই। ওই কাব্যগ্রন্থে
একটি কবিতা আছে, কবিতার নাম ‘দীপেন বললেই’। কয়েকটি লাইন, ‘’দীপেন বললেই আমার চোখে
ভেসে ওঠে/ একটা প্রকান্ড গাছ/ ঝড়কে যার থোড়াই কেয়ার।/ দীপেন বললেই দেখতে পাই এক
চওড়া বাঁধ। যার কাছে নতজানু/ সমস্ত প্লাবনের জল।‘’ আমার সেই সময়ের আবেগ প্রবণ
বন্ধুটির মনে হয়েছিল কবিতাটি আমাকে নিয়ে লেখা। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়ে
বলেছিলাম না আমাকে নিয়ে নয়। কবি পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতাটি তাঁর প্রিয় বন্ধু এবং
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে রেখে লিখেছেন।
কতটা প্রাসঙ্গিক হবে জানি না। তবুও লিখতে চাইছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাতাশা মুনকুর এর কথা এখন আমরা প্রায় সবাই জানি। এই শতাব্দীর
প্রথম দশকের শুরুতেই ‘টু ইন টাওয়ার’ নামক এক আভিজাত্য তাসের ঘরের মত লুটিয়ে পড়ে।
সে দিনটা ‘৯/১১’ নামে পরিচিত। এরপর অ-শ্বেতাঙ্গ নাতাশা এক ভয়াবহ লাঞ্ছনার মধ্যে
দিন অতিবাহিত করে। তবুও হার না মেনে লড়াই করতে থাকে। মুক্তির পথ খুঁজে পায়
‘বর্ণ-বিদ্বেষের’ বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মহম্মদ আলির জীবন দর্শনে। সংখ্যাগুরু
অভিজাতদের স্বরূপ চিনতে দেরি হয়। তবে চিনব মনে করলে চেনা যায়। এইসব গোষ্ঠীর
সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ঐতিহ্য এতটাই দীর্ঘ যে এইসব গোষ্ঠীর মানবতার নামে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর
পরিচয় নির্ণয় করতে পারি না। লাঞ্ছিত মানুষদেরও সময় লাগে। উদাহারণ প্রখ্যাত
চলচ্চিত্র পরিচালক চার্লি চ্যাপলীন। তাঁর ব্যক্তি যন্ত্রণার ক্যানভাস। বহুলখ্যাত
ছবি ‘সিটি লাইট’। ওই ছবিতে আমরা মদ্যপ অভিজাতদের করুণা চিনেছি। নাতাশার কাছ থেকে শিখলাম জীবনের
সমস্ত অপমান, লাঞ্ছনাকে সহ্য করেও তিনি মানবতার পক্ষে কাজ করছেন। বিভিন্ন
সম্প্রদায়ের শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন। যে স্বেচ্ছাসেবী
সংস্থায় তিনি যুক্ত হয়েছেন সেটির নাম ‘আলি সেন্টার’।
আভিজাত্যের চেতনার মান সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে দেখলাম কিছুটা। আর্থিক পরম্পরা
দেখা যাক। ভারত নামক দেশটা নাকি আধুনিক গণতন্ত্রের স্বাধীনতা ভোগ করছে। অনুভব
করছে। চেতনার মান বেড়েছে। কোটিপতির সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। জাতীয় আয়ও নাকি
বাড়ছে। করের টাকায়। কর কারা দেয়? কি ভাবে দেয়? একটা পরিসংখ্যান পাচ্ছি। ২০১৪-২০১৫
অর্থবর্ষে ভারতের মোট জন সংখ্যার মাত্র চার শতাংশ আয়কর রিটার্ন জমা করেছেন।
২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল জনসংখ্যার এক শতাংশ মাত্র। সূত্রটি বলছে ভারতে মাত্র ১১
লক্ষ মানুষ নিজেদের বাৎসরিক আয় দশ লক্ষ টাকার বেশি বলে ঘোষণা করেছেন। আভিজাত্যের
পরম্পরা দেখার আরও ভারমুক্ত আধুনিক সমাজের ভাষা খুঁজতে হবে আমাদের। তবুও স্বপ্ন
থাকে। বিশ্বাস থাকে। ভাবালুতা থাকবে। জেগে থাকবে আশা। যদি স্বাধীন অর্ধেক আকাশ
দাও। বাতায়ন খুলে দেখি। আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, ‘’Freedom is the last, best hope of the earth.’’
এখন আমরা আছি ‘কফি হাউস’ এ। কলকাতা শহরের নামীদামী ব্যক্তি, ছাত্র,
ছাত্রনেতা, লেখক, লেখিকা, বুদ্ধিজীবী সব্বাই আসে। আসতেই হয় আভিজাত্যের শ্মশান
কাঠের উত্তাপে। কফি হাউসে আসতেই হয়। এখানে জাত নেই। ধর্ম নেই। বর্ণ নেই। সমস্ত হল
ঘর জুড়ে কথা ছুটছে। কথা তো বলার জন্যই। আজ আমার সঙ্গে কমল আছে। কমল কোনদিনই নিয়মিত
কফি হাউসে আসেনা। কমল নাগরিক ভাষা বা ভালো বাংলায় কথা বলতে জানে। কিন্তু এক একদিন
ওকে ‘আলকাপ’ পালার নায়কের মেজাজে পাওয়া যায়। সেদিন ও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। ওর
চেনা ভাষা। কমলের নিজের ভাষা। গাঁ-গঞ্জের ভাষা। আজ সেই মেজাজে আছে। কমল বলল, ‘লেবু
দিঙ লাল চা লয়। লাল কফি দিতে বুল ক্যানে।‘ বললাম, এখানে চা পাওয়া যায় না। হয় দুধ
দেওয়া কফি না হলে দুধ ছাড়া কফি পাওয়া যায়। যেটাকে ‘ব্ল্যাক কফি’ বলে।
কমল বলল, ‘‘ঠিক আছে রে ভাই আমার। আচ্ছা একটা কথা বুল, ‘’এই যে তু নিজের কথা
কাউকে বলিস না। ক্যানে? সালটো কত হবে? ১৯৭৯ অথবা ১৯৮০। ওই বছরে তু একটা পরিবারকে
বাঁচালছিলি। কিছুলোক টিনে করি কেরোসিন লিং ওই বাড়িটোতে আগুন লাগাতে আলছিলো। তু
সবার সামনে দাঁড়িঙ বুলাছিলি, ‘আগে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাও। তারপর ওই
বাড়িতে আগুন লাগাবে।’ কেউ আর এগোতে চাইলে না। তুকে এত মানত সব। কি বুল ঠিক বুললাম?
পরে আম্পুরহাটের এসডিও এসাছিল। থানা পুলিশ। তুর ইজ্জত বেড়ি গেল।‘’
আমি বললাম, ওসব সাধারণ বিষয়। থাক। আলোচনা করে কি হবে?
কমলকে থামাবে কে? উত্তর দিল, ‘’বিনয়ের ঝাউগাছ হছিস ক্যানে? এটাও সবাই জানে।
ওই সময়ের লোকগুলান। ১৯৮৪ সালে একটা দল তুকে ৭ লাখ টাকা দিতে চাইলে। একদম নতুন একটা
দল। মাত্র চার বছর বয়স তখন নতুন দলটোর। আজ সেটা কত বড় দল হলছে। বিনিময়ে ওই দলের হোলটইমার হতে হবে। তু কি করলি?
চুপচাপ থাকলি। বাপরে বাপ। ভূতের বাপের নাম ভুলে যাওয়ার মত টাকা! তু কিনা ছেড়ি দিলি?’’
আমি চুপ করে থাকলাম। কমল বলতে থাকল, ‘’কিছু নেতাকে আমরা চার দশকধরি মানুষের
সঙ্গে তঞ্চকতা করতে দেখল্যাম, অরা আমাদের কি করবে বুলতো? এই আমাদের জান (কমলের ডান
হাত ওর বুকের কাছে।) হছে ‘কইমাছ’ এর জান। যত কাদায় ফেলবি তুরা আমরা লাফিং তুদের
সাদা জামায় লেপ্টে যাব। কি বুলছিস তু?’’
আমি মুচকে হাসলাম। কফি খেতে খেতে বললাম, রাজ্যের ডান-বাম সব দলের কিছু নেতা
সম্ভবত সৎ বামপন্থী, ডানপন্থী শিল্পী, লেখক, কবি, নাট্যকর্মী, নিজেদের দলের
কর্মীদের ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’ সংস্কৃতিতে রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল।
কফির বিল মিটিয়ে আমরা নীচে নেমে আসতেই দেখি হুতোম একটা বইয়ের স্টলের চালে
বসে আছে। আমাকে বলল, ‘তুই আবার কফি হাউসে এসছিস?’
বললাম, হ্যাঁ তিন বছর পর এলাম।
হুতোম বলল, ‘আর এসে কি করবি? কতজনকে আঁতেল বানালি, নিজে এখন ‘বিড়ি চোর’ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।’
কমল বলল, ‘’অ্যাই দেখ দেখি কান্ড,
আতের বেলার পাখিটো দিনের বেলায় চিল্লাচ্ছে ক্যানে?’’
হুতোম কি শুনতে পেল? কারণ ততক্ষণে রাতের পাখি উড়ে চলে গেছে।
No comments:
Post a Comment