যুগান্তের প্রণাম
কেউ বলে একুশে আইন।
আমরা বলি একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার দিন ভাষার দিবস। মুক্তির দিন। বন্ধন মুক্তির
দিন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতির দিন। ভাষা দিবস। বসন্ত পলাশের লালে লাল। আকাশের নীল প্রান্ত থেকে কৃষ্ণ চূড়া ছুঁয়ে আদিগন্ত প্রাচুর্যের স্পর্শকাতরতা।
রাধাচূড়ার হলুদে হলুদে অবিশ্রান্ত স্মৃতি। নীলকণ্ঠ পাখির ডানায় চড়ে ফিরতে ইচ্ছে হয়
কবি জীবনানন্দের গ্রাম বাংলায়, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-র
পথে পথে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জল জংলার দেশে। অতীন
বন্দ্যোপাধ্যায় রাঙামাটির আটচালায় নিয়ে গেলেন। নীল আকাশের সামিয়ানা চেনালেন। নিজের
দেশের ভাষা চেনালেন। বাংলা ভাষা। সেখানে আজও সাদা বকেদের ঠোটে সবুজ নালী ঘাস। শরতের
কাশফুল বর্ষার মেঘ শেষে ঠাকুর বাড়ির দালানে। পেঁজা তুলোর মত আগমনী ভৈরবী। ‘ঢাক কুড়
ঢাক কুড়’ উদুম গায়ে ঘর ছুট বালকবেলা। শিউলীর মেঘমল্লার যেন কাঠালী চাঁপার ঘ্রাণ। শরতের
ইমন রাগের সুরে ‘বার ঘর এক উঠোন’। আমার বাংলা মাছরাঙা নদী ঘাটের প্রথম প্রেমের নূপুরের ছন্দ। পুকুরের জলে
শাপলা খেলে। কলস কাঁখে কাজলা গাঁয়ের বধূর লাজুক পদচারনা। খোঁপায় গাদা ফুল। বাঁশ
বনের নিঝুম দুপুড়ে অচেনা পাখির ঐকতান। আমার বাংলা। বাংলার মাটি ভারতভাগ্যবিধাতা। প্রাচীন
ভারত যত আধুনিক হয়েছে ততই ভারতবর্ষে বাঙালির পরিচয় আমরা পেয়েছি তার সাহিত্য ও তার
স্বাধীনতার সংগ্রামে।
তথ্য বলছে এই বাংলা, বাংলাদেশ, উত্তর পূর্ব ভারত সহ দেশের অন্য রাজ্যের
প্রবাসী বাঙালি এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বসবাসকারী বাঙালির সংখ্যা আনুমানিক ৩০
কোটি হবে। বাজার অর্থনীতির বণিকসভা বলবে বিরাট ‘মার্কেট’। আমাদের জানার প্রয়োজন
আছে কি নেই সেটা সময় বলবে। তবে নিজেদের ভাষার টানে, ভাষার অধিকারে আমরা স্বাধীন এক
ভূমন্ডল চাই। কোনও কবি এক সময় বলেছিলেন আমরা ভাষায় এক। আমরা মানবতায় এক। এই ছন্দে উচ্চারণ করি আমরা চেতনায় এক, আমরা ভালোবাসায় এক।
বাংলা ভাষা, বাংলা জাতি নিয়ে পণ্ডিতরা আরও বিস্তারিত লিখতে পারেন। আগেও
লিখেছেন। আগামীতেও লিখবেন। আমি সময়ের দাবি মেনে দু’চারটে তামাটে বাক্যালাপ করতে
চাইলাম। এই সুযোগে বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল লেখকের কিছু কথা উল্লেখ করি।
‘’হাজার বছরের পুরাণ বাঙলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’-এই নামে ‘চর্যাচর্য
বিনিশ্চয়’, সেই সঙ্গে সরোজ বজ্রের (সরহপাদের) ‘দোহাকোষ’ ও কাহুপাদের ‘ডাকার্ণব’ এই
তিনখানা পুঁথি একত্র সম্পাদিত করে স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ পক্ষ থেকে বাঙলা ১৩২৩ সালে (ইংরাজি ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে)
একখানা কবিতা-সংগ্রহ প্রকাশ করেন। এর মধ্যেকার ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ই একমাত্র
খাঁটি বাঙলায় লেখা পদ বা গান বলে গ্রাহ্য হয়েছে। সাধারণত ‘চর্যাপদ’ বলেই বাঙলা
সাহিত্যে এর পরিচয়, যদিও আসল নাম কারও কারও মতে ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’,
‘চর্যাশ্চর্য বিনিশ্চয়’, ইত্যাদি। অর্থাৎ নামের সম্বন্ধে বিনিশ্চিত হবার এখন আর
নেই; তবে ‘চর্যাপদ’ নামটিই আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে প্রচলিত।‘’ (বাঙলা সাহিত্যের
রুপরেখা, গোপাল হালদার, এ, মুখার্জী, পৃষ্ঠা- ৩ )
আমরা বাঙালি জাতি হিসাবে নিজেদের কবে থেকে চিনতে শিখলাম? অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ
ইত্যাদি আলোচনা, বিতর্ক ছিলই। সমাজতাত্ত্বিকরা ভাবছেন। ভাষাবিদরা ভাবছেন।
ইতহাসবিদরা ভেবেছেন। আরও আলোচনার জন্য ভাবছেন। নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, ‘বাঙলার
ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের চারিশত বৎসর নানাদিক হইতে গভীর ও ব্যপক অর্থ বহন করে।
বর্তমান বাঙলাদেশ ও বাঙালী জাতির গোড়াপত্তন হইয়াছে এই যুগে; এই যুগই প্রথম বৃহত্তর
সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ’।
ভাষা এবং জাতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা ভাষা আরও
আধুনিক হয়েছে। বিস্তার হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া নামক আরও এক নতুন মাধ্যম নতুন ভাষায়
কথা বলছে। সম্প্রতি বাংলা ভাষা সহ ভারতের প্রধান প্রধান আঞ্চলিক ভাষার অভিভাবকরা
চিন্তিত। আধুনিক প্রজন্মের নাগরিকরা গতিশীল দুনিয়ায় নিজেদের মত করে ভাষা তৈরি করে
নিচ্ছে। কেউ কেউ হিন্দি+ ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করে কথা বলছে। কেউ কেউ বাংলা+হিন্দি+ইংরেজি তিনটে ভাষার
শব্দ ব্যবহার করে বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে। অভিযোগ সমাজের ভাষা
অভিভাবকদের। আমার ব্যক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে যতটুকু জানি ‘বাংলা’ ভাষার
বপু অনেক অনেক বড়। সাগরের থেকেও বড়। বাংলা ভাষা এতটাই উদার যে এই ভাষা বিভিন্ন
দেশের বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে আজ এক সমৃদ্ধ ভাষা। তৎভব সময়কাল পেরিয়ে এসে
তৎসম যুগে আমরা পৌঁছেছিলাম। তারপর অপভ্রংশ পরম্পরা ভেঙ্গে চলিতভাষা। এই দীর্ঘ
সময়কালে বাংলাভাষা আপন ছন্দে নিজস্ব অভিধান গড়ে নিয়েছে। আগামীতেও আমরা সেইসব
তাত্ত্বিকপন্থা অবলম্বন করেই ‘বর্তমান প্রগতি’ খুঁজে নেব ভাষাবিদ ডঃ সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাকরণ অনুসরণ করে। উইলিয়ম কেরি, রামমোহন রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব
গৌড়ীয় বাংলা ব্যকরণ এবং ভাষা নিয়ে আলোচনা
করলেও বৈঞ্জানিকভাবে ভাষা চর্চার কাজ শুরু হয়েছিল সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। মনে
রাখতে হবে ডঃ সুকুমার সেনের তিন খন্ডে ‘বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস’-এর কথা। বৈজাত্য
সংবিধান ভেঙ্গে। বাগীশ্বরী নদীর সাধনায়।
যে সময়টাই আমরা আজ দাঁড়িয়ে আছি এটা একটা যুগ সন্ধিক্ষণের সময়। পাতায় পাতায়
মর্মরিত হচ্ছে নতুন যুগের আহ্বান। কান পাতলে টাপুর টুপুর শিশির পড়ার আওয়াজ শুনতে
পাই। পল্লীসমাজ ভেঙ্গে গড়ে উঠছে ভুবনগ্রাম। বাণিজ্যিক গ্রাম। কর্পোরেট ভিলেজ। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রাচীন এক
জনপদের কথা। প্রাক ‘রেনেসাঁ’ সময়ের কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন এমনই এক
যুগসন্ধিক্ষণে। ভারতীয় নবজাগরণের মাঝামঝি সময়ে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি এলেন তার
সমস্ত সামগ্রীকতা নিয়ে। ১৮৬১ সালে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সাল। উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে
দীর্ঘায়ত এক বিতর্ক রয়েছে। দেশের ইতিহাস বেত্তা বা বুধিজীবীদের অনেকে ভিন্ন ভিন্ন
মত পোষণ করেন। বিদেশীদের মধ্যেও নানারকম মতামত রয়েছে। ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির সময়
সেটা। ওই সময় যেসব ভারতীয় প্রাণপুরুষ নবজাগরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন
তাঁদের আমরা চিনি। তারা তাঁদের চিন্তায়, বিভিন্ন সামাজিক কাজে এ দেশে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছেন।
আমাদের দেশে সবরকম প্রগতিশীল সামাজিক মূল্যবোধ গঠন, জাতীয় আন্দোলন, আন্তর্জাতিক
চেতনার প্রাথমিক প্রেরণা আমরা পেয়েছি সেইসব ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্ত যুগপুরুষদের কাছ
থেকে। এই নবজাগরণের খ্যপাটে বাতাস কখনও এসেছে সম্মিলিতভাবে। কখনও ব্যক্তিগতভাবে।
আবার অনেক সময় গোষ্ঠীগতভাবে। বিতর্ক থাকতে পারে তাঁদের সবটা ঠিক ছিল না। কিন্ত
তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। বিশেষত প্রধান চারজনকে আমরা খুঁজে নিতে পারি। রাজা
রামমোহন, পণ্ডিত বিদ্যাসাগর, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ।
তিনজনকে নিয়ে রবি ঠাকুর অকৃত্রিম উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। ভগ্ন আশা, বা এক
আশাহীন সময়ে যে পটভূমি তখন ছিল, রবীন্দ্রনাথ গভীর এবং অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দীর্ঘকায়
এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে দেখেছেন। তিনি বলছেন, ‘রামমোহন রায় যখন ভারতবর্ষে
জন্মগ্রহণ করেন তখন এখানে চতুর্দিকে কালরাত্রির অন্ধকার বিরাজ করিতেছিল। আকাশে
মৃত্যু বিরাজ করিতেছিল। মিথ্যা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাঁহাকে সংগ্রাম করিতে
হইয়াছিল।...... অঞ্জানের মধ্যে মানুষ যেমন নিরুপায় যেমন অসহায়, এমন আর কোথায়।
রামমোহন রায় যখন জাগ্রত হইয়া বঙ্গসমাজের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন তখন বঙ্গসমাজ
সেই প্রেতভূমি ছিল।’ (রামমোহন রায়)
রবীন্দ্রনাথ দেশের সামগ্রিক ঐতিহ্যের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগরকে একই বন্ধনীতে
রেখে বলেছেন, ‘একদিকে যেমন তাঁহারা ভারতবর্ষীয়, তেমনি অপরদিকে যুরোপিয় প্রকৃতির
সহিত তাঁহাদের চরিত্রের বিস্তর নিকট সাদৃশ্য দেখিতে পাই। ...... বেশভূষায়,
আচারে-ব্যবহারে তাঁহারা সম্পূর্ণ বাঙালি ছিলেন। স্বজাতীয় শাস্ত্রঞ্জানে তাঁহাদের
সমতুল্য কেহ ছিল না; স্বজাতিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মূল পত্তন তাঁহারাই করিয়া
গিয়াছেন......’ (বিদ্যাসাগর চরিত), ঋণ- নবজাগরণ ও রবীন্দ্রনাথ, সুশীল জানা।
কালীপ্রসন্ন সিংহ ঘোষণা করেছিলেন, যে ব্যক্তি বিধবা বিবাহ করবেন তাঁকে এক
হাজার টাকা পুরষ্কার দেবেন।
ব্রিটীশ ভারতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চার
পীঠস্থান ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এই বাংলার কলকাতা। ব্রিটিশ ভারতে রবীন্দ্রনাথ
ছিলেন বাঙালির জীবিত অভিভাবক। মৃত্যুর পরে আজও তিনি আমাদের অভিভাবক রয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ
নিয়ে আম বাঙালির উচ্ছাস একটুও কমেনি। সম্প্রতি আমি আমার স্ত্রীর বান্ধবী মঞ্জুলার বাড়ি গিয়েছিলাম। বালিগঞ্জে। আমার স্ত্রীও সঙ্গে
ছিল। মঞ্জুলা বললেন তাঁর ব্যক্তিগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা। মঞ্জুলার
কথায়, ‘’আমার প্রথম সন্তান ১৯৯১ সালে প্রসবের সময় মারা যায়। তারপর আমরা আবার
চেষ্টা শুরু করি। কলকাতার এক প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জকে দেখাই। তিন চারটে
বৈঠকের পরে ডাক্তারবাবু জানান, আমার স্বামীর শুক্রাণু পরীক্ষা করাতে হবে। তাঁর
পরামর্শ মত তাঁর ল্যাবে পরীক্ষা করানো হয়।
রিপোর্ট আসে আনুপাতিক হারে আমার স্বামীর শুক্রাণু কম আছে। তাই মেনে নিয়ে
আমরা ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে বসে থাকি। কারণ তখন ‘টেস্টটিউব বেবি’ নেওয়া
ছিল যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। আমাদের একজন
নিকট আত্মীয়ের পরামর্শে অন্য আর এক বড় ডাক্তারকে দেখাই। তিনিও শুক্রাণু পরীক্ষা
করান বড় একটি ল্যাব থেকে। সেই পরীক্ষার রিপোর্টে আমার স্বামীর শুক্রাণুর হার ঠিক
এল। আমার দিক থেকে অসুবিধা ছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনার গর্ভে সন্তান নষ্ট হওয়া
এবং শুক্রাণু কাউন্টের হার কম করে দেখানো সবটা একটা পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
সেটা আমার বিষয় নয়। বললাম এই জন্য যে আপনারা এসেছেন আমার এক বিশেষ বন্ধুর
রেফারেন্সে।’ এই ঘটনার পর আমি একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাকে মুক্তি দিয়েছে
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। আমি সুযোগ পেলেই রবীন্দ্র সাহিত্য পড়ি।‘’
মঞ্জুলা অভিজাত পাড়ার এক পোড় খাওয়া নারী। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বাঙালি নারী। ব্যথা বেদনা থেকে মুক্তি পেতে
খুঁজে নিয়েছে বাংলা সাহিত্য। রবীন্দ্র সাহিত্য। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা যুগান্তের পদচারণায়
যতই সামনে এগিয়ে যাবে, আমরা ততই নিকট থেকে দূরে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নেব এই বাংলায়
এবং সমস্ত চরাচরে। সীমাবদ্ধ ঞ্জান নিয়ে আর না এগিয়ে আবার এক মাঠ ঘাটের অভিঞ্জতা শুনি আমরা। একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছি, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির শুটিং-এর আগে সন্তোষ দত্ত
বিঞ্জানীর চরিত্রটির ডায়ালেক্ট কেমন হবে তাই নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। সন্তোষ দত্তের
কথায় ‘’মানিকদাকে বললাম। উনি বললেন, শোনো, যখন ধড়াচূড়া গায়ে উঠবে, দেখবে সংলাপ
নিজের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। যেটা তখন বলবে, সেটাই হবে তোমার স্টাইল! কী অদ্ভূত
শেখানোর কায়দা বলতো!’’
হিন্দোল সেই ধড়াচূড়া গায়ে নিয়েই সম্ভবত কথা বলে। হিন্দোল আমার থেকে দু
বছরের ছোটই হবে। হিন্দোল আমার ছোট বেলার বন্ধু। কিছুদিন আগে বীরভূমে দেশের বাড়ি
গিয়েছিলাম। নিজের বাড়িটাওতো নেই। আমি নিজেও দেশ ভাগের যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
বীরভূম গেলে তাই হোটেলেই থাকি। কিন্তু এবার বাধ্য হলাম হিন্দোলদের বাড়িতে একরাত
থাকতে। গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হিন্দোল। পূর্ব বঙ্গের ‘ডাঙ্গা’ নামের একটি
গ্রাম থেকে ওর বাবা, আমার বাবা সবাই পরিবার নিয়ে এসেছিল ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার সময়। হিন্দোলদের বর্তমান পাড়ার নাম
সম্ভবত ডাঙ্গাল পাড়া। হিন্দোল ক্লাশ নাইন টেন পর্যন্ত পড়েছে। ওর বাবার যে জীবীকা
ছিল হিন্দোলের জীবীকা একই। সকাল সকাল বাড়ি থেকে ধুতি-গেঞ্জি পড়ে হাতে পিতলের ফুলের
সাজি নিয়ে শহরের বিভিন্ন দোকানে ফুল-বেলপাতা দিয়ে পুজো করে। মাসোহারা চুক্তিতে। ছোটবেলা
থেকেই ওর টিকি ছিল। সেই কারণে ওকে ছোটবেলায় অনেকে ‘হিলাইলা’ বলে ডাকত। হিন্দোল
অনেক সময় রেগেও যেত। তবুও ওকে নিত্যপুজো করতেই হত। আজও সেই একই কাজ করে ও।
হিন্দোলদের মাটির এক কামরার বাড়ি এখন বারান্দা, রান্নাঘর, পায়খানা,
বাথরুমসহ দু’কামরার ইটের বাড়ি। টিনের
ছাউনি। সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ হিন্দোল ওর
নাতিকে বলল, ‘’এই পুলা তর মুখোশটা কোথায় আসে?’’
নাতি বলল, ‘’রাক্ষসের মুখোশ। আইনা দিমু?’’
হিন্দোল মুখোশ পড়ে বলল, ‘’শুনো গিয়া আমাগো ঘরে পুরানো একখান ঘূর্ণায়মান
চেয়ার আসে। চেয়ারডার দুইডা চাকা এহন খালি খুইলা যায়। আমি যখনই চাকা দুইখান লাগাই
একখান ছোট নেংটি ইঁদুর কান খাড়া কইরা বইয়া থাকে। কয়, ‘চোখ দিয়া দেখাতাসি কত্তা,
কান দিয়া দেখতাসি না।’