বাংলার চতুষ্পাঠী
দীপেন্দু চৌধুরী
আকাশ সেদিনও খোলা আজও চিরঅম্লান আহ্বানে
উন্মুক্ত। তবুও এক সুদৃঢ় শৃঙ্খলায় আমাদের জানান দিচ্ছে, বিশৃঙ্খল সাময়িকভাবে
বাহুল্যহীন মনে হতে পারে। স্থায়ীভাবে কি সম্ভব? ঠিক তেমনি স্বাধীনতা তথা মত
প্রকাশের স্বাধীনতা মানে বিশৃঙ্খলা নয়। সম্প্রতি ‘সোশাল মিডিয়ায়’ একটি দুটি
অপ্রয়োজনীয় পোস্ট নজরে পড়ছে। এই সব লেখা সামাজিক জীবনে ব্যপক দূরত্ব তৈরি করতে
সহায়ক হয়। ধরা যাক কোনও এক নাট্য ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক
ব্যক্তিত্ব, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত এমন অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তি। এই সব ব্যক্তিদের
পরস্পরের ধারাবাহিকভাবে কয়েক দশকের সুসম্পর্ক আছে। কেউ ‘সোশাল মিডিয়া’ ব্যবহার এবং
উপভোগ করেন কেউ কেউ করেন না। তবুও বর্তমান ‘লক্ষ্মী চঞ্চলা’ সময়ে একটা ‘শৃঙ্খলা’ খোলা আকাশের উদার ন্যায় নীতি মেনেই
চির বহ্নিমান হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ‘ফেসবুকে’ শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব শাওলি
মিত্রকে নিয়ে একটি অবাঞ্ছনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় লেখা আমার নজরে পড়েছে। যদিও আমি
লেখাটি শেয়ার করিনি। এবং করতেও চাই না। আমাদের অসময়ে এই সব ব্যক্তিরা আড়াল থেকে
কাউকে বুঝতে না দিয়ে ভালো কিছু করার জন্য উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তিনি এবং তাঁরা এসএমএস
করেন ‘তোমরা ভালো থেক’। ‘তোমার নতুন কাজের শুভ কামনা করি। সাফল্য কামনা করি’। এই সব ব্যক্তিরা ‘নাথবতী অনাথবত’
হয়েই থাকেন। বছর চারেক আগে শাওলীদির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি তাঁর সঙ্গে
বিগত মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি কোনও যোগাযোগ
নেই। তাঁর এক সহকর্মী তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ২০০৯ থেকে
২০১৬ পর্যন্ত যোগাযোগ রাখছেন। তাই ব্যক্তি শাওলী মিত্র তিনি ‘বঙ্গশ্রী’ উপাধীতে ভূষিত
হলেন না ‘নাট্যশ্রী’ তে ভূষিত হলেন সেটা তাঁদের মত ব্যক্তিত্বদের কাছে কিছু এসে
যায় না। নাট্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা এবং বাংলার নাট্য আন্দোলনে তাঁর কতটা অবদান সেটা
আজ ইতিহাস। সম্ভবত তিনি ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করেন না। আর যারা আমাদের ‘আঁধার মানিক’ সস্তায় উপহার
দিতে চান তাঁদের আলিঙ্গনের আহ্বান জানিয়ে বলছি, সোনার হাঁস চিনতে জানালেন না।
‘পাভলভ’ তত্বের ঘণ্টা কি করে বাজাবেন? হয় নিজেদের সংহত করুন না হলে নাট্য
অ্যাকাদেমির শুকনো বাগানের পরিচর্যা করুন। বাগানের রঙ দেখার কি দরকার? আপনি বা আপনারা কি করবেন সেটা বলা মানে খোলা
আকাশের আন্তরিক আহবানকে অবঞ্জা করা হয়! ‘কানা ছেলের নাম পদ্ম লোচন’। গত কুড়ি কুড়ি
বছর আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে নাটক ওয়ালাদের ‘বহুরূপী’ মঞ্চের দর্শক
আসনে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা হয়নি। এবং একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই নিজের সত্য-অসত্য
‘সংলাপ’ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম ‘রুদ্ধ সংগীত’ শোনার রুদ্ধ দ্বার আজও খোলার অবকাশ
পাইনি। কেউ কেন যেন বারে বারে বলে ‘এখনো
গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাঁধা’। ‘নাট্যজন’ সমাজের বাইরে থেকে চিনেছি অনেক অনেক
আলোক বর্ষের তারকাদের। মানবতার কাজ করতে গেলে নির্দিষ্ট কোনও পাত্র বা জলাধারের কি
প্রয়োজন? মানবতার কি কোনও পদবী হয়? কোনও পুরষ্কার দিয়ে বলতে হয়, ‘আপুনি মানবতার
জন্য কাজ করুন গা’। নাট্য ব্যক্তিত্ব হতে গেলে ‘পানিপার’ ও হতে হয়। বলা শোভা পায় না ‘আমি কি
পানি পার’? বাল্কল পড়ে যে সব প্রণাম্য ব্যক্তি বাংলার রঙ্গালয় গড়ে দিয়ে গেছেন।
তাঁরা জল বয়ে আনা থেকে ‘বারবণিতাদে’র বাংলার নাট্য মঞ্চে নিয়ে এসে নাট্য সেবক তথা
নাট্য সেবায়েত করে গড়ে তুলেছেন। পরে এঁরা সকলেই নাট্য পূজারী হয়েছেন।
‘এক পুরুষে করে তিন পুরুষে খায়’ এই প্রবাদটার
ব্যবহারিক উপযোগিতা কি সব সময় পাওয়া যায়? এই বাংলার কিছু স্বনামধন্য পরিবার আছে।
তাঁরা তিন পুরুষ, চার পুরুষ এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে এই বাংলার নীল আকাশের নীচে
আমাদের আলো দিচ্ছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, অমর্ত্য সেন, নরেন
দেব, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্ত, উৎপল দত্ত, উত্তম কুমার,
সুচিত্রা সেন, কমল কুমার মজুমদার, প্রফুল্ল সরকার, (পৃষ্ঠপোষক) ইত্যদি। প্রতি মুহূর্তে স্মরণযোগ্য এইসব পরিবারকে আমাদের ‘বাংলার
চতুস্পাঠিতে’ ব্যকারণ পড়াতে এবং পড়তে লাগবেই। চারদেওয়ালের চারপেয়েতে বসেও বলা যায়
‘আমি যাবই বাণিজ্যেতে যাবই’।
নাটকে রাজনীতি সেদিনও ছিল আজও আছে। উৎপল দত্ত
সম্পাদিত ‘এপিক থিয়েটারে’র বিশেষ সংখ্যায় (১৯৮১) ‘রাজনৈতিক থিয়েটার ও আত্ম
সমালোচনা’ প্রবন্ধে হীরেন ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘’এদিক থেকে দেখতে গেলে রাজনৈতিক
থিয়েটার আগেও ছিল এখনো আছে। বাংলা নাটকের উদ্ভবপর্বে রামনারায়ণ-মাইকেল-দীনবন্ধুর
নাটকে সামন্ত ব্যবস্থা বিরোধী, প্রগতিশীল, সেক্যুলার সারবস্তু ছিল তা অবশ্যই রাজনৈতিক
কেননা তাতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সার বস্তুরই শিল্পরূপ আমরা পাই।
পরবর্তীকালে গিরিশ-অমৃতলালের যুগে নাটকে একই সংগে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার
প্রগতি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক প্রশ্নে নানা পরাগগতির চিহ্ন দেখা দিয়েছিল তাও
রাজনৈতিক বিষয়ই। পরাগতির দিকটাও রাজনৈতিক পরাগতি বলেই ধরতে হবে, কেননা তাতে বুর্জোয়া
শ্রেনীর বিপ্লবের দিকস্থিতি (অরিয়েন্টেশান) পরিবর্তনের প্রতিফলনই ঘটেছিল।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের নাটকেও উদ্ভবপর্বের রাজনৈতিক চিন্তার ফলগুধারা তাঁর শেষ
পর্বের (রথের রশি ইত্যাদি) নাটকে ফলগুতত্বের অবগুণ্ঠন ত্যাগ করে প্রকাশ্যেই
প্রবাহিত। এ যুগেই মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ পৌরানিক নাটকের বাতাবরণে সম্পূরণতই
রাজনৈতিক নাটক। (হতে পারে তাতে গান্ধিবাদের প্রভাব রয়েছে, কিন্তু গান্ধীবাদও একটি
রাজনৈতিক মতবাদ)। তারও পরবর্তীকালে গণনাট্য আন্দোলন তো রাজনৈতিক থিয়েটারকেই তার
ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে। আজকের দিনে পশ্চিমবংগে যে অসংখ্য গ্রুপথিয়েটার
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এরা প্রত্যেকেই তাদের রাজনৈতিক ধ্যানধারণাকেই নাট্যরুপে
উপস্থিত করছেন! এটা হতে পারে যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সকলেই ঠিক এক
জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই।‘’ (পৃষ্ঠা- ৫৪)
বাংলার অচল পয়সা নিয়ে খেয়াল তামাশা করার সময়
আমরা সম্ভবত পেরিয়ে এসেছি। ধ্রুপদী বাংলার তান গত দু’বছর আগে টান টান ভৈরবী সুরের
পল্লবিত লহমায় বাধাঁ শুরু হয়েছে। আপনি বা আপনারা সেই যঞ্জে সম্মিলিত হবেন কি হবেন
না সেটা অবশ্যই ‘বৃহন্নলা’ কাহিনীর চিত্রনাট্যে লেখা থাকবে। অবঞ্জা ঞ্জাত সারে হোক
অথবা অঞ্জাতসারে। তাম্বুক সেবন করে হোক বা স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতায়। অথবা ‘সবার চৈতন্য’ হোক এই গরিমায়। আপনাদের
আস্তেই হবে নব ‘বাংলার চতুস্পাঠি’তে।
No comments:
Post a Comment