দীপেন্দু চৌধুরী
অচেনার আনন্দ। অজানাকে জানার আনন্দ যারা খোঁজেন তাঁরাই শুধুমাত্র দেখতে পান
এমনটা নয়। বংলা সাহিত্য এবং বিদেশী সাহিত্য আমাদের চিনিয়েছে অচেনার আনন্দ। অজানার
আনন্দ। কিন্তু সঙ্গীত যখন আপামর মানুষকে টেনে নিয়ে যায় বিশ্বের দরবারে তখন সত্যি
সত্যি আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। বিশ্বসঙ্গীতের দিকপালেরা রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ,
রবীশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, মোৎজার্ট, বেটোফেন এবং সত্যজিৎ রায়, বব ডিলান । এই সব নামের একই সরণীতে প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং
পাশ্চাত্যের আরও অনেক নাম এসে যায়। কিন্তু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া একটি নাম আমাদের
সামনে এনে দিল কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজ। আরও বলা ভালো ফ্রেঞ্চ ন্যাশন্যাল
লাইব্রেরী (বিএনএফ)। দেবেন ভট্টাচার্যের সৃষ্টির সংগ্রহ এখন থেকে পাওয়া যাবে
বিএনএফ-এর সাউন্ড আর্কাইভে। বিংশ শতাব্দীর এক কালজয়ী সংগ্রহ ধরা আছে এই সংগ্রহে।
এত বড় কাজটি করেছেন বিএনএফ-এর ডাইরেক্টর জিয়ান নওয়ল জিয়ান্নেনি(Jean Noe”l Jeanneney)।
সঙ্গীতের জন্য তিনি সারা বিশ্ব ঘুরেছেন। সঙ্গীতকে
আশ্রয় করে সমস্ত বিশ্বটা হয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের দেশ। পাশ্চাত্যকে জানার অদম্য
কৌতূহল নিয়ে তিনি ১৯৪৯ সালের ৫ নভেম্বর লন্ডন পৌঁছন। ব্রিটেনে তিনি কর্মজীবন শুরু
করেন পোস্ট অফিসের চাকরি দিয়ে। কিন্তু তাঁর স্থান সেখানে নয়। তিনি খুঁজছেন ধ্রুপদী
ঘরানার সঙ্গীত। তাই অস্থির মন, অস্থির চিত্ত নিয়ে তিনি খুঁজে চলেছেন বিশ্বের
ধ্রুপদী সঙ্গীত, লোকগান। সন্ধান তিনি পেলেন। সুযোগ করে দিল বিবিসি রেডিও। বিবিসি
সেই সময় একজন ভারতীয়কে খুঁজছেন যিনি তৎকালীন ভারতীয় সিনেমার গান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
বিবিসি খুঁজছে সেই ব্যক্তিকে ভারতীয় সেই ব্যক্তি আরও জানবেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত
এবং ভারতীয় লোকসঙ্গীত। এই সমস্ত গুণ ছিল যে ব্যক্তির তাঁর নাম দেবেন ভট্টাচার্য।
১৯২১ সালে বারানসিতে জন্ম দেবেন ভট্টাচার্যের। পড়াশোনা করেছেন ‘টোল’-এ। জীবনের
কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম দিকটা বারানসীতে দিন কেটেছে তাঁর। প্রথামাফিক শিক্ষা তাঁর
হয়নি। তৎকালীন সময়ে তিনি পুরনো ভারতীয় পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। সেই সময়ের মত করে
ধুতি পড়তেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে নতুন আলো দেখছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বিশ্বের দ্ধস্ত
সমাজ। দেবেন সদ্য কর্ম জীবন শুরু করেছেন। প্রথম জীবনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কেরানীর
চাকরি। বীমা সংস্থায় এজেন্ট এবং পার্ট টাইম সাংবাদিকের কাজ একসঙ্গে করেছেন। সময়টা
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি। এই সময়কালে তাঁর সঙ্গে দু’জন ইউরোপীয়ের দেখা
হয় বারানসীতে। একজন রেমন্ড বার্ণার (Raymond Burnier) এবং দ্বিতীয়জন আলিয়ান দানিলু
(Alian Danie’lou). রেমন্ডের আগ্রহ ছিল ভারতীয় শিল্প এবং স্কাল্পচার বিষয়ে। আর আলিয়ানের
আগ্রহের বিষয় ছিল ভারতীয় সঙ্গীত। স্বশিক্ষিত দেবেন সংস্কৃত পড়েছিলেন ‘টোল’-এ
কিন্তু পরের ইতিহাস আমাদের চমকে দেয়। কবি লিউইস টমসন তাঁর জীবনে একটা মস্তবড় বাঁক
এনে দিয়েছিলেন।
ব্রিটেনে বিবিসি রেডিওর অভিঞ্জতা নিয়ে ১৯৫৪ সালে
দেবেন ভট্টাচার্য স্বনামধন্য ইন্ডোলজিস্ট হয়ে দেশে ফেরেন। সংস্কৃত ‘টোল’-এ পড়া সেই
দেবেন তখন পাশ্চাত্য সভ্যতায় স্নান করে ফিরেছেন আধুনিক মনন নিয়ে। কিছুদিন দেশে
থেকে ফিরলেন লন্ডনে সঙ্গীতের অভিযাত্রী হয়ে। গ্রীস, ইতালি, তুর্কি, ইরাক, জর্ডন,
ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সঙ্গীতের উপর কাজ করলেন। এবং সেইসব সুর ‘আরগো
রেকর্ড’ থেকে প্রকাশিত হয়। পরে ‘ইএমআই’ থেকেও রেকর্ড বের হয়। এই সময় দেবেন
ভট্টাচার্যের ভাগ্য খুলে গেল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে সুইডেন সরকার প্রযোজনা
করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন একটি ছবির জন্য। তাঁদের আর্থিক সহায়তায় দেবেনবাবু তৈরি
করলেন ইউরোপীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার উপর সিনেমা। এই তথ্যচিত্র সুইডিশ সরকার
দেশের শিশুদের সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষাশিবিরের জন্য প্রচারের কাজে ব্যবহার করে। পরে
পরেই বিবিসি টেলিভিশন আগ্রহ প্রকাশ করে দক্ষিণ ভারতের ধ্রুপদী নৃত্য ‘কথাকলি’ এবং
রাজস্থানের ‘কথক’দের (storytellers) বিষয়ে। দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন তিনি। দর্শকদের থেকে ব্যপক প্রশংসা পায় ছবি দুটি।
তথ্য বলছে একটা সময় কমিউনিস্ট কবি স্টিফেন
স্পেন্ডার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার জন্য লিখতে বলেছিলেন দেবেন ভট্টাচার্যকে।
‘এনকাউন্টার’ পত্রিকায় ভারতীয় কবিতা নিয়ে তাঁকে লিখতে বলেছিলেন স্টিফেন স্পেন্ডার।
আরও জানা যাচ্ছে দেবেন ভট্টাচার্য ৪০০ ঘণ্টার সঙ্গীত বিষয়ক রেকর্ড তৈরি করে গেছেন।
১৫, ০০০ সাদাকালো এবং রঙ্গীন ছবি তুলেছেন। সেই ছবি শিল্পরসিকদের কাছে আজও মূল্যবান
স্থীরচিত্র। ২২টি স্বল্প দৈর্ঘের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বেশ কয়েকটি বই
লিখেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল বিষয়ক বই ‘দ্য মিরর অফ দ্য স্কাই’।
দেবেনবাবুর কাজের ধারা দেখে সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যচিত্র পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন
দেশ থেকে ডাক পেতে থাকেন। চিন, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের হয়ে তিনি ছবি তৈরি করেছেন।
বিবিসিতে কাজ করার সময় থেকেই তিনি পরিচয় লাভ করেন,
একাধারে রেডিয়ো-প্রযোজক, রেকর্ড-প্রযোজক, লোকশিল্প-বিশেষঞ্জ, লেখক, কবি, অনুবাদক,
চলচ্চিত্রকার। এক পাত্রে কত রত্নের সমাহার। তাঁকে যেমন অভিযাত্রী বলা যায় আবার শিল্প
অভিযাত্রায় যেন ছিলেন পরিযায়ী পাখি। ইউরোপ এশিয়া ঘুরতে ঘুরতে প্যারিসে পেয়ে গেলেন
পথ চলার জীবনসাথীকে। ১৯৬৯ সালে বিয়ে করলেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ঝর্না বসুকে। এবং
প্যারিসে পাকাপাকিভাবে থেকে গেলেন। দেবেন ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি ছবি করেছেন
স্তেফান জুরদ্যাঁ। ছবির নাম ‘মিউজিক অ্যাকর্ডিং টু দেবেন ভট্টাচার্য’। ১২ ডিসেম্বর
কলকাতায় আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজে ছবিটি দেখানো হয়। এদিন তাঁর লেখা ‘প্যারিস টু ক্যালকাটাঃ
মেন অ্যান্ড মিউজিক অন দ্যা ডেজার্ট রোড’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করেন
বাংলাদেশ উপ দূতাবাস, কলকাতা-এর উপরাষ্ট্রদূত তৌফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘’আমার
সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক পুরনো। আমার কর্মজীবনের প্রথম পোস্টিং ফ্রান্সে। দেবেন
ভট্টাচার্য অবিভক্ত ভারতের মানুষ। ইউরোপ থেকে সঙ্গীত শিখে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন।
তিনি বিঞ্জানী ছিলেন না। তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের সাম্রাজ্যে
অনায়াসে বিচরণ করেছেন। আমরা গর্বিত দেবেন ভট্টাচার্যের জন্য।‘’
ইউনিসেফের মুখ্য ফিল্ড অফিসার মহম্মদ মহিউদ্দিন
বলেন, ‘’আমি দেবেন ভট্টাচার্যের লেখা পড়েছি। আমার মনে হয়েছে কবি নজরুল ইসলামের
সঙ্গে তাঁর জীবনের মিল আছে। স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি। সঙ্গীতের জন্য লড়াই
করেছেন। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে ভালো বেসেছিলেন।‘’
ঝর্না বসু বলেন, ‘’উনি যে বই লিখবেন আমরা স্বপ্নেও
ভাবিনি। তাঁর সম্পর্কে আমি আর কি বলব? বিশ্বের যেসব গুণীজনের সঙ্গে তিনি জীবন
কাটিয়েছেন তাঁরা তাঁর সম্পর্কে বলে গেছেন। ফরাসি সরকার তথা আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ,
কলকাতার আধিকারিকদের ধন্যবাদ। তাঁরা বিস্মৃত এক ব্যক্তিকে বাঙালির গর্বের শহরে
নতুন করে পৌঁছে দিলেন।‘’ 

No comments:
Post a Comment