মানবতার পক্ষে আছি অধর্মে নেই জিরাফেও নেই:
প্রকৃতি তোমার চিরনন্দিত অপরূপ শোভা তুমি কেন
লুকিয়ে রাখতে পার না? অতি সাধারণ জীবনের যেটুকু অভিঞ্জতা হয়েছে, যৌবনের বিহান
বেলায় প্রথম চোখের ভাষায় বিহার, ঝাড়খন্ড, অসম, ওড়িশা, মেঘালয় এই কয়েকটি পাহাড়তলীর
রাজ্য একসময় দেখেছি। উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, লঝমন ঝোলা, হরিদ্বার দেখেছি। আহা
কি সে অপরূপ সৌন্দর্য। অকৃপণ সবুজের মায়াময়তায়, মেঘতলির সদাহাস্য কুঠুরি খুলে বসে
আছে অচেনা এক নিষ্পাপ কুমারী নারী। অতি সন্তর্পণে ছুঁয়ে বলে আমি তোমার সেই মেয়ে। এসো আমাকে আলিঙ্গন করো। পাশে
ঝোরা আছে। নদী আছে, গঙ্গা আছে। ছুঁয়ে যাও আমাকে, সব কলঙ্ক পাপ ধুয়ে যাবে। আমি আজ
তোমার প্রেমিকা হব। ভালোবাসার পাহারি জংলা রঙের ভেলা নিয়ে বসে আছি। কত রঙের
প্রজাপতি উড়ছে দ্যাখ আকাশে বাতাসে। রঙিন প্রজাপতি গাছের পাতায় পাতায় ঘুরছে নব
যৌবনের বাতায়ন খুলে। গাছের ডাল, পাতা, ফুলের রেণু নিঙরে প্রাগে পরাগে সম্মেলনের
কবিতার চরণ লেখে। পয়ার ছন্দে। প্রেম এসে ফিরে যায় একাকি গহন বনে। এসো তুমি জলে জঙ্গলে। বলো, হে বন্য নারী
আজ আমি তোমার প্রেমে তৃপ্ত। পাত্র উজাড় করে ভরিয়ে দাও আমায়। আহ্বান করে অচেনা বন্য সুন্দরী
তনয়া যেন বলছে, তুমি পুরুষ, তোমার ক্লান্ত শ্রান্ত ঘর্মাক্ত শরীর দেখলে আমার
নারীত্ব আমাকে আরও শান্ত করে রাখে। আমার ঘৌমটা খুলে অদেখা সুন্দরকে উজ্জ্বল করো। প্রজ্বলিত করো। অদেখা অচেনা সুন্দরের কাছে আজ
তোমাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। আমি তোমার সেই বন্য নারী।
সপ্ততরীর ঢেউ ভাঙা অকৃত্রিম মেঘমল্লারের নৃত্যে ‘তাতা
থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ’ ছন্দে রাজপ্রাসাদের রাজকীয়তা নিয়ে ডেকে পাঠাও সকলকে। সবুজ
বৃক্ষরাশি কখনও বৈশাখী ঝঞ্ঝায়, কাল বৈশাখীর উথাল পাথাল আন্দোলনে প্রলয়ের বড় গল্প
শোনায়। অবিরাম বৃষ্টি শেষে ‘টুপ টুপ, টুপ টুপ’ পাহাড়ি ঝোরার চেনা অচেনা খিল খিল
হাসি। কে একজন প্রশ্ন করে ‘এ বাবু হেথাকে কখন এলি?’ শরতের এলোমেলো মেঘ সাদা সাদা
বকেদের ডানায় ডানায় আবার সে ফিরে ফিরে আসে, ছোট নাগপুরের আদিবাসী গ্রামের ‘আরণ্যক’
উপাখ্যানের বহু বর্ণনায়। হে আমার অচেনা প্রকৃতি তোমার প্রলয় রুদ্র মুরতি সৃষ্টির
বন্ধন ভেঙ্গে আগুনে পোড়া মানবতা ছুঁয়ে যায়।
যে আকাশে বাদলের গান শুনি সেই আকাশে সাদা কালো,
লাল নীল, হাজারো রঙের পাখ পাখালির কলরব। চেনা অচেনা আকাশেও দবন্দ থাকে, অসীম
আদিগন্ত কালো মেঘেদের অন্তরালে অবিরাম আকাশ দখলের সচেষ্ট অভিলাষ থাকে। ওরা
পক্ষীরাজের দেশের ভাষায় কথা বলে। এতবড় আকাশ, প্রকৃতি সেও তোমার স্বপ্ন দেখানো ঘুম
ভাঙা ভোরের দিগন্ত বলয়। এই বলয়ে পাখিদের দবান্দিক অবলোকন আহ্বান করে দেশ বিদেশের
পরিযায়ী পাখিদের। সাগরের চরাচরে, নদীর বালুকা বেলায়, হ্রদের শীতল উষ্ণতায় পরিযায়ী
পাখি অক্লান্ত যাত্রা পথে অধর্মকে শাসন করে মানবতার চড়ুইভাতির আনন্দে। পটুয়া
শিল্পীর গ্রাম্যপটে ছবি হয়ে উড়ে বেড়ায় তাঁরা। বলে আমরা আকাশেও আছি, মাটিতেও আছি,
তোমার আঙিনায় থাকব। এই জগৎসভায় পরিক্রমা করতে করতে বারে বারে বলি জিরাফের পীঠে
বসতে চাইনা। হাঁটব জিরাফের পথরেখায়। গ্রাম্য পটুয়ার আঁকা আলভাঙা সড়কের পল্লবিত
পক্ষীবালিকার নূপুরের তালে তালে। বলব অধর্মে নেই মানবতায় আছি।
সেদিন অনেকদিন পর এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বইপাড়ায়
গিয়েছিলাম। পরিযায়ী পাখিদের মত ঘুরতে ঘুরতে যাযাবর জীবনটা চিনতে কলকাতার প্রাচীন
বৃক্ষরাশির ছায়াতলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অতীতের কথকতা, স্মৃতি, ভাঙা ভাঙা ছন্দে
হাঁটি হাঁটি এসে আলিঙ্গন করছে। আমি উদাস চাউনিতে হেরিতেছি ক্লান্ত, পথভ্রস্ট আহত
কবুতরের মতো। কলেজস্কয়ারের পূর্বদিকের গেটের সামনে তখন কিছু লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে।
সামনে কিছু একটা দেখছে। ভিড় দেখলেই যেমন আম বাঙালি ভিরে যায়। দেহাতী বাঙালিদের মতো
আমিও গলা ঢুকিয়ে দিলাম। ভিড়ের গলতা দিয়ে দেখলাম আমাদের সমবয়সি একজন লোক হাতে একটা
আড়াই ফুট লম্বা পুতুল নিয়ে কি সব দেখাচ্ছে। পুতুলটা পুরনো নতুন কাপড়ের ছোট ছোট
টুকরো সেলাই করে তৈরি করা হয়েছে। পুতুলের পোশাকে বোঝা গেল পুতুলটি পুরুষ চরিত্র।
জিনসের প্যান্ট। দুটো পকেট দেওয়া জলপাই রঙের জামা। জামার একটা পকেটে ভারতের ‘জাতীয়
পতাকা’-এর স্টীকার আলাদভাবে সেলাই করা আছে। কোমরে চওড়া চকলেট রঙের বেল্ট। পুতুলের
মুখটায় সার্কাসের ‘জোকার’-এর মতো করে রাঙানো। যে লোকটা পুতুলটা ধরে আছে তাঁর বাবরি
চুল। পেল্লাই বড় এক দাড়ি। পোশাক পড়ে আছে সেও এক বিচিত্র। গায়ে পুরনো দিনের বাঙলা
সার্ট। গায়ক হেমন্তবাবুরা যেমন সার্ট ব্যবহার করতেন। ঢোলা পায়জামা। পায়ে কাঠের
খড়ম। লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা লাঠিতে বাঁধা একটা প্ল্যাকার্ড ধরে আছে।
প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘মানবতায় আছি, অধর্মে নেই জিরাফেও নেই’। নীচে ছোট করে লেখা ‘তিরপিতা’। বুঝলাম ‘তিরপিতা’ মানে গোষ্ঠীর নাম।
লোকটা বলছে, ‘এই দ্যাখেন দাদা, দিদিরা এই পুতুলটো
এখনও অর দ্যাশের ভাষায় দশের ভাষায় কথা বুলে। ইটো পুতুল নাচের ইতিকথা লয়। আমি মানিকবাবুর
ভাষায় কথা বলতে পারিয়ে না। আমার পুতুল কি বুলছে আপনারা শুনেন।’
লোকটা জানতে চাইল, ‘গোবরা তুমাহার বাড়ি কুথায়?’
‘ওই তিরপিতা গাঁয়ে। কাঠ ব্যবসায়ী হর্ষবাবুদের
পাড়ায়।’ পুতুল উত্তর দিল।
লোকটা জানতে চাইল, ‘গোবরা তুমহার লিখা পড়া কতদূর?’
‘আঞ্জে বিপিএল কার্ড নাইখো। পঞ্চায়েতে বাবুরা
বুললে বিপিএল কার্ড না থাকলে স্কুলে পড়া চলবে না। আমি বুললাম আমার বাপের
বিদ্যাসাগর ছিল না আমাহার ‘বিপিএল কার্ড’ লায় বাবু। আর স্কুলে লিলে না।’
‘আচ্ছা গোবরা তুমি এখন কি কাজ কর?’
‘কাজ কুন্ঠি পাব? আমি বামুন-কায়েত, সদগোপ চাষির
ছেলা যে আমাকে কাজ দিবে? আবার দ্যখেন আহমি সিডিউল কাস্ট লই। দলিতও লই। বাপের পদবী
ছিল ‘মাল’। তবে আমার বাপ একদম মাল চিনতে শিখেনি। ওই লেগি আমার এই হাল হুলো কাকা। একশো দিনের মাটি
কাটার কাজেও কেউ লিছে না। আমাকে কাজ দিলে আমি নাকি ‘পুকুর চুরি’-এর কথা সবাইকে
রসিয়ে রসিয়ে বুলি দিব?’ এই কথা কি ঠিক? আপনি বুলেনতো কাকা? আমি কি পঞ্জজনের ঢুলি?
ধান্দা আমিও বুঝি। মাগ্যিগণ্ডার দ্যাশে পাঁচ দশ টাকা কমিশন সব্বাই খেছে।
‘আমাকে আজ কাকা বলছ ক্যানে? ঠিক আছে, ঠিক আছে,
তুমি কাজ না করলে সারাদিনের খাওয়া খরচ, বাড়ি ঘর মেরামতির টাকা, চিকিৎসার খরচ এইসব
কুথা থেকি পেছ?’
‘ এই যে আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছি। পাঁচটো কথা
বুলছি। সাপের পাঁচ পা দেখার কথা লয়। ওই আপনার মতো বাবুদের কথা। সেই কথা শুনি গাঁ
গঞ্জের দাদা দিদিরা আনন্দ পেছে। তারপর অরা যা দিছে তার ভাগ আমাকে কিছু দিছেন আপনি
মামা। তবে কিনা ফাউল করছেন আপুনি।’
‘তুমি গোবরা একবার ‘কাকা’ বুলছ, একবার ‘মামা’ বুলছ
ক্যানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আর ফাউল কি করলাম?’
‘আপনি বুলাছিলেন আপনার একশো টাকা আয় হলে তিরিশ
টাকা আমাকে দিবেন। একশো তিরিশ টাকা আয় হলেও তিরিশ টাকা আহমাকে দিবেন। আপনি কি
করছেন? আমাকে তিরিশ টাকা দিছেন আপনি? ১২ টাকা দিছেন। তবে ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে ১২
টাকা পেছি। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট করি দিয়াছেন। আর ১৮ টাকা ভাউচার লিখে ছিঁড়ে দিছেন,
ভাউচার ছিঁড়ে দিছেন। ১৮ টাকা আপনি পকেটে পুরছেন। ইটো ফাউল লয় জামাইবাবু? পিএফ
দিছেন না, ইএসাই করি দেননি। তবু আহমার এক চোখ লিং আপনার সাথে কাজ করছি। এই গুলান
ফাউল লয় জামাইবাবু?’
‘সে না বুঝলাম, তা এতসব মেনে লিং আমার সঙ্গে কাজ
করছ ক্যানে শালো?’
‘এইবার ঠিক বুল্লেন, কলকাতার যে খানে যেছি সবখানে
আপনাদের লোক। আমার বা দিকে দ্যাখেন যে লোকগুলান বসি আছে ওইখানে আপনার মতো
জামাইবাবু অনেক পাবেন। আবার ডান দিকে দ্যাখেন ওইখানে মামা,কাকাদের দল পাবেন
জামাইবাবু।’
এতক্ষণ যে সব কোতুহলী মানুষ ‘পুতুলের কথা’ শুনছিল
তাঁরা অনেকেই বিছিয়ে দেওয়া চাদরে পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোট, একটাকা দুটাকা, পাঁচ
টাকার কয়েন ফেলছিল। এদের মধ্যে থেকে একজন বলে ফেলল ‘এই যে পুতুলের মালিক তুমিও
বাংলার বাইরের ব্যবসা শিখে গেছ বস?’
ভিড় পাতলা হতে থাকে। মালিক ধমক দিয়ে পুতুলকে বলে,
‘কি সব বুলছ তুমি আজ গোবর? এবার কি করবে? ভিড় যে পাতলা হুং গেল?’
‘আঞ্জে কি আর করব? হর্ষবাবু বুলাছিল কলকাতার সব
রাস্তা থিকা চেতলা যাওয়ার ৩৩ নম্বর দোতলা বাস পাওয়া যায়। আমি ইবার ওই বাস ধরি
‘নবান্ন’ দেখতি যাব। পুলিশবাবুরা ভিতরে ঢুকতে দিলে পঞ্চুকাকুকে বুলব আহমাকে তিনটা
কার্ড দেন। একটো ‘সিডিউল কাস্ট’ কার্ড, একটো কাজ পাওয়ার জব কার্ড আর একটো ‘হেলথ
কার্ড’। আমার চোখে ‘ন্যাবা’ হলছে।’
পুতুলের মালিক এরপর আর কথা না বাড়িয়ে গোবরকে
মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের উদ্দেশ্যে বলল, ‘গোবরের শরীরটা
ভালো নেই। আজ ওকে একটু বিশ্রাম দিন। আবার একদিন আমরা ওর কথা শুনব।’
’
No comments:
Post a Comment