হেমন্তের অবতরণিকা:
আমার প্রিয় কবি শঙখ ঘোষ আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আমি আজ আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। প্রশ্রয়ের সঙ্গে বলতে হয় আমার কি এমন
যোগ্যতা আপনাকে নিয়ে শব্দ বাক্য রচনা করি? সত্য সে তার গতি যতই মন্থর উপলব্ধি হোক,
বাস্তবের নিয়ম-অনিয়মের দোলাচলে। ন্যায়ের নিয়ম ফিরবেই। ন্যায়দণ্ড আজও ঠাকুর বাড়ি,
বিশ্বভারতী, শিলাইদহে আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। আমরা নতজানু হয়ে পরস্পর পরস্পরে
প্রাচুর্যকে ছুঁয়ে দেখি। আজ শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় ব্রাহ্ম সঙ্গীত উচ্চারণে
বাংলার বর্ণময় মেলার আরাধ্য প্রাচুর্যে আমরা কবিগুরুর চরণের কাছে বসে আছি। এইদিন
আরও সমৃদ্ধ হলাম যখন শুনলাম আপনি জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাচ্ছেন। সময় যত গড়িয়েছে আমরা
কাব্য সাহিত্যের তৃষ্ণার্ত আপামর বাঙালি প্রতীক্ষা করেছি আমাদের বাংলার গর্ব, বাংলার
বিবেক জানি জগতসভায় আপন আসনে বসবেন। আর তিনি আমাদের বলবেন, ঞ্জান যেখানে
মুক্তধারার মত অবগাহন করে আমি এবং আমরা সেই স্বচ্ছতোয়া অববাহিকায় থাকতে চাই।
কবি শঙ্খ ঘোষ এই সেদিন এসেছিলেন। সমর সেন শতবর্ষ
অনুষ্ঠানে। ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬-এর শীত সন্ধ্যায়। এক পত্রিকার সম্পাদক তাঁর মুখবন্ধ
বক্তব্যে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। সম্পাদক বললেন, ‘’সমর সেনের মত মানুষ চলে
গেছেন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চলে গেছেন। আমাদের সঙ্গে আছেন শঙ্খ ঘোষ।‘’ পরে সভায়
কিছু বলার জন্য কবিকে আহবান জানানো হল। তিনি এলেন। মুখে চপট গাম্ভীর্য। অথবা
অব্যাক্ত অভিমান। নিশ্চয় নিজের জন্য নয়। বাংলা তথা ভারতের ন্যায়দণ্ডের জন্য। দেশের
চেনা বিবকের খোজে। কতদিন কবি কথা বলেননি। স্বল্পবাক কবি কাশফুলের মত সাদা
ধুতি-পাঞ্জাবি, শাল জড়িয়ে পোডিয়ামে এলেন। সমস্ত সভাঘর শব্দহীন। নিস্পলক নয়নে আমরা
আলোআঁধারি মঞ্চে চেয়ে আছি। কান খাড়া করে। তিনি অনেক কথা বলবেন। কোনও নতুন কথা পুরনো শব্দের
ভাবগাম্ভীর্যে নতুন ছন্দে।
শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘’সমর সেনের শতবর্ষে দীপেশ বক্তৃতা
করবেন। আমাকে আহ্বান না জানালেও আমি চলে আসতাম। আপনাদের সঙ্গে দর্শক আসনে বসে
দীপেশের কথা শুনতাম। সারা দেশে মনুষত্বের যে অবক্ষয় সেখানে সমর সেনের মত একজন
মানুষের কথা আলোচনা হবে আমি আসব না? এটা কি হয়? প্রাণ শক্তিটা ফিরে আসুক।‘’
এই প্রজন্মের বাংলার তরুণদের তথা দেশের তরুণদের
কবি আহ্বান জানালেন। তাঁর সেইসব দিনের চেনা পথ আমাদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। সত্তর
দশকের মাঝামঝি সময়। রক্তলেখায় বাংলার ইতিহাস, সাহিত্য, কবিতা নতুন ভাষা খুজছে।
বাংলার জাগ্রত বিবেক গর্জে উঠেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ভিয়েতনামের মানুষের মুক্তির
দাবিতে। ফ্রান্সের ছাত্রদের উপর অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মানুষের
মুক্তির দাবিতে। মাতৃভাষার গর্বিত অহংকারের পাশে এই বাংলার বিবেক। ওইসময় কবি শঙ্খ
ঘোষ তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘’দলবদ্ধ হবার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। নিজের পখে সাধ্য যতটুকু ততটুকু করব।‘’ সম্ভবত সেই সময় তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও
রৌদ্র’ গল্পের কয়েকটি লাইন পড়েছিলেন। ‘’শশিভূষণ.........কহিলেন, ‘জেল ভালো। লোহার
বেড়ি মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তু জেলের বাহিরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে
প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে.........।‘’ (ঋণ- শিলাদিত্য সেন)
ষাটের দশক থেকে যদি আমরা কবি শঙ্খ ঘোষকে দেখি
তাহলে জানতে পারব তাঁর ধারাবাহিকতা। যেসব প্রাঞ্জ ব্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষকে কাছ থেকে
দেখেছেন বা দেখছেন তাঁরা আমার থেকে অনেক অনেক ভালো বলতে পারবেন কবির কথা। আমরা শেষ
যে অধ্যায় জ্ঞানত দেখলাম সেটা ‘সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম’ পর্যায়। চার দশক পর বাংলা তথা
ভারতের এক অবক্ষয়ের ছবি সমস্ত পৃথিবী সেই সময় দেখতে পেয়েছে। রাজনীতির ভাষা এবং
কৌশল নিজ নিজ দল ঠিক করে। যেমন নীতিও সেই দল ঠিক করে। আমাদের আলোচনা সেই নীতি বা
কৌশল নিয়ে নয়। এটা সেই পরিসরের আলচ্য বিষয় বস্তুও নয়। কিন্তু তখন অবুঝ মানবতার যে
পদচারণা আমরা শুনেছি। তাঁর প্রতিবাদ করাটা সমস্ত বিবেকবান মানুষের দায়বদ্ধতা ছিল।
শঙ্খ ঘোষ চুপ করে থাকেননি। প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। বাংলার ‘পরিবর্তন’-এর এখানেই
শেষ নয়। দল, মতাদর্শ সব কিছু কেমন যেন জবুথুবু। কখনো কখনো উথাল পাথাল প্লাবনে ‘আমরা-ওরা’ সব মিশে যায়। দিনের আলোয় ‘আমরা-আমরা’, ‘ওরা-ওরা’ আলাদা। সন্ধের পর আকাশের তারাদের আর চেনা যায় না। উত্তরের
আকাশে যে তারা আজ দেখা যায় পরের দিন দক্ষিণের আকাশেও সেই তারা
উজ্জ্বল ভাস্বর। সময়ের বিবর্তনে স্বার্থানেবষি মানুষ নিজেদের মঞ্চ খুঁজে নিয়েছে। সিঙ্গুর
আন্দোলনের দশ বছর পর আজ গুটি কয় মানুষ একা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি শঙ্খ ঘোষ।
১৯৭৩ সালে মণীন্দ্র গুপ্ত এবং রঞ্জিত সিংহের যুগ্ম
সম্পাদনায় ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা ১৯৭২’ প্রকাশ হয়। প্রবীণ এবং তরুণ কবিদের কবিতা
আছে ওই সংকলনে। শঙ্খ ঘোষের কয়েকটি কবিতা আছে। তারমধ্যে অন্যতম কবিতা ‘মূর্খ, বড়ো,
সামাজিক নয়’- ‘’ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?/ চতুরতা, ক্লান্ত লাগে
খুব?/’’ ..............................কবিতার শেষ স্তবকের তিন লাইন, ‘’যদি তাই
লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও।/ কী বা আসে যায়--/ লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বল্বে সামাজিক নয়। ‘’ (পৃষ্ঠা- ৯০ )
No comments:
Post a Comment