Sunday, 30 December 2018

স্বেচ্ছাচারী



দীপেন্দু চৌধুরী
এখানে বরফ পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। আমরা উত্তরের বাসিন্দা নই। আমরা দক্ষিণের জানলা খুলে চেয়ে থাকি। শুনি উত্তরে ঝির ঝির করে বরফ পড়ছে। ঢেকে ফেলেছে উত্তরের পাহাড়ের জনবস্তির ছাদ, চা বাগানের ঠিকে শ্রমিকের ঝুপড়ি। গাছের পাতায় বরফ, দেশে নগরায়ন হয়েছে। নতুন বাড়ি, নতুন গাড়ির ছাদে বরফ। পুরনো কাঠের বাড়ির চালে তির তির করে বরফ পড়ছে। পাহাড় ডাকছে আয় আমার কোলে আয়। সারল্য আর একঝাঁক সাদা বকেদের সঙ্গে পাহাড়ি বোনেদের গান শুনবি। সাত পাহাড়ের গান শুনবি। বাঁশি শুনবি। আয় আমার কোলে আয়। আমার স্পর্শের ওম নিয়ে যা। আয় ঘুম। ঘুম ছুটেছে। ঘুম ছুটছে আঁকা বাঁকা রেল, পাকদন্ডি রাস্তার উঁচু নীচু বাঁকে। পাহাড় আমায় ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমি কোন পাহাড়ের কাছে যাব? আমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। সভ্যতার পাছায় চুম্বন দিয়ে কে যেন বলছে তোমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। জাত পাতের বজ্জাতি দেখতে গিয়ে নতুন জাতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমার পাহাড় তাঁরা গ্রাস করে নিল।
মাত্র ১০ থেকে ১৫ ফুটের উচ্চতা। লাল টকটকে বাঁক খাওয়া সূর্যের আলো এসে যখন ঠিকরে পড়ত ছোট্ট টুকরো টুকরো পাহাড়ের পাথরে, লাল পাথর জানান দিতে চায়হিস হিস করে স্বাধীন বিষধর সাপেরা পৌষের শীতে ঘুমের ঘরে আশ্রয় নিত। আয় ঘুম আয়। আতা গাছে কি এই সময় আতা হয়? ভুলে গেলাম। ভুলে গেছি। আমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। আমি দারুন স্বেচ্ছাচারী। তখন আমার পাহাড়ে ওঠার রাস্তা ছিল না। সে সময় চাঁদ এসে উঁকি দিলে ডাহুক পাখি ঝর্ণার জলে সান্ধ্য স্নান করে কোথায় আবার হারিয়ে যেত। ওদের শীত করে না। ওদের শীতঘুমও নেই। কিন্তু আজ ওরাও কোথায় হারিয়ে গেছে। পাহাড় থেকে বিষধর সাপেরাও হারিয়ে গেছে। আমার ঝর্ণাটাও কেড়ে নিয়েছ! কেন এসব হয়? গত দু’তিনটে মাস আমাদের আশেপাশে ঘুঘু ডাকছে। জানান দিচ্ছে দুপুরের স্মৃতি। ভোরের ভোরবেলা। আমার তোমার ছেলেবেলা।
সভ্যতার পাছায় চুম্বন খেতে খেতে কে যেন বলে গেল পাহাড় কখনও হারায় না। পাহাড় কখনও ঘুমোয় না। এইতো আজকের কাগজেও আছে ৭২ বছর পরে ফিরে পেলেন এক নারী তাঁর স্বামীকে। তাঁর কৈশোরবেলার বন্ধুকে। আবেগে দু’জনের দু’চোখে তির তির করে চিরযৌবনের বরফ, শিশির পড়ছে। অনুভূতির ওম ওদের ৭২টা অদেখা বসন্ত ছুঁইয়ে দিল। বরফবেলায় ৭২ বছরের প্রেম! একজন ৯৩য়ের যুবক দ্বিতীয়জন ৮৯ বছরের অভিমানী যুবতী। প্রেম! কে চেনে? কারা চেনে? পাহাড় তুমি হারিয়ে যেও না। পাহাড় তুমি আর সকলের থেকে আলাদা। তোমার একদিকে মন্দিরে ঘণ্টা বাজে। পূবদিকে পিরের দরগা। আমার পাহাড়ে আছে একটা নীম গাছ। পশ্চিমপাড়ে মিঠে নীম পাতা। পূবদিকে তেতো নীম পাতাএইতো আমার পাহাড়। পাহাড় কি হারিয়ে যায়? পাহাড় ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়ে হুতোম আসে। যে পাহাড়ে যাই সেই পাহাড়ে হতোম থাকে। গাজনের সময় থাকে। দুগগি পুজোয় হুতোম আসবেই। ইদের নামাজে হুতোমকে চেনা যায়। বড় দিনে বড় পাহাড়ে এসে হুতোম বড় ঘণ্টা বাজায়। হুতোম সান্টাক্লজের বন্ধু। আমি ওকে না মানলে কি হবে? হুতোম না থাকলে পাহাড়ও আর আমায় ডাকবে না। নদীও হারিয়ে যাবে। পাহাড় নদী না থাকলে সভ্যতা কোথায় পাব? সেদিন যেমন হুতোম না থাকলে আমি বন্ধু কোথায় পেতুম?
পার্কস্ট্রীট থেকে চৌরঙ্গীতে এসে মেয়ো রোড না ধরে চৌরঙ্গী মানে জহরলাল নেহরু রোড ধরে হাঁটছিযাব প্রেসক্লাববা দিকে বড় রাস্তার উপর সার দিয়ে পাহাড়ের মত থুরি পয়সাওয়ালা বড়লোকদের বাড়ির মতো বড় বড় বাস দাঁড়িয়ে। ফুটপাথ গোড়ালিভেজা ইউরিয়া জলে ভর্তি। হুসুর জল আর কি?  সভ্যতার পাছায় চুম্বন খাওয়ার কথা আমাকে হুতোম শিখিয়েছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে পারছি না। বড় রাস্তার বা দিকে সারি সারি নাগরিক বাস দাঁড়িয়ে। শীতের বেলা। আমজনতা ভীড় করে জটলা করছে। করবেই। বাসের আড়ালে যুবক-যুবতির আড়াল খোঁজা আলিঙ্গন। আমার পেছন থেকে একটা হর্নের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমার পেছনে কেউ চুম্বন দিতে চাইছে। দেখুন ঠিক সেই সময় আমার ডান দিকের কানের ভেতরটা সুর সুর করল। আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে কানটা চুলকে নিচ্ছিলাম। আঃ কি আরাম। না হল না। আমার সামনে বাঘের কায়দায় এক মোটরবাইক আরোহী সামনের একটা থাবা দিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। বাইকের সামনে চাকাটা বড়বাবুদের বাসে ঠেকিয়ে আমাকে হাজতে পোড়ার মতো করে দাঁড়াল। অথবা আমি ৪৫ নম্বর রুটের  বাস ড্রাইভারের মতো ট্রাফিক নিয়ম ভেঙ্গেছি। ভদ্রলোক আমাকে জিঙ্গেস করল ‘’আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তায় হাঁটেন?’’ আমি বললাম ‘আমার কানটা একটু সুর সুর করছিল।’ ভদ্রলোক আমাকে হঠাত বললেন, ‘’আমিও তাহলে এভাবে থাকি।‘’ ততক্ষণে আমি দেখে নিয়েছি। ভদ্রলোকের বাইকের হেড লাইটের কভারে পাহাড়ের মত করে না থুরি আইনের শব্দে লেখা ‘পুলিশ’। বুঝলাম ট্রাফিক পুলিশ। রাস্তার ব্যামো আছে এঁদের। ভীষণ রাগ। পুলিশ বলে কথা। আমি জানতে চাইলাম আমার অন্যায়টা কি? ট্রাফিক পুলিশ আমাকে টনিক না দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। মাথার উপর থেকে হুতোম বলল, ‘স্যার কিছু মনে করবেন না। ‘ম্যাচ’ করে গেছে। আপনার পাহাড়ি বাইক আর আমার কানের সুর সুরি ম্যাচ করে গেছে।’ হুতোমের কথা রাস্তার ব্যামো সারানোর ট্রাফিক পুলিশ শুনতে পাবে না। তাই আমি কথাগুলো বললাম। মনে হল কাজ হয়েছে। সঙ্গে বললাম ‘আমি কিছু অন্যায় করিনি বড় বড় বাবুদের  এই বড় ছোট বাসগুলো ধর্মতলারমতো বড়রাস্তায় রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? দাঁড়িয়ে থাকে কেন? এটা অন্যায় নয়? ফুটপাথে গাছ লাগিয়ে দিন, ইউরিয়া লাগবে না। এটা কি? লিন্ডসে স্ট্রীটের উল্টোদিকের রাস্তা? না চেতলা যাবার গলতা? তিলোত্তমা কলকাতার মলমূত্র ত্যাগ করার এটা জায়গা?’ হুতোম ফুট কাটল ‘স্যার বর্ষবরণের আর তিনদিন বাকী। ‘ম্যাচ’ ফিটিংস? না ‘ম্যাচ’ করে গেছে? আপনার দাপুটে এবং স্বাধীন বাইকের হর্নের শব্দ আর আমার কানের সুরসুরি। আপনার কোন নার্সিং হোমে জন্ম স্যার?’ আমি এই কথাটা আর উচ্চারণ করলাম না। বড় বড় থাবাওয়ালা রাস্তার ব্যামো সারানো পুলিশস্যার কিছুটা এগিয়ে আমাকে পরখ করতে লাগল। আমি কোনদিকে যাই।                  
হুতোম আমাকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সতর্ক করে দিলে। ‘আজ মদ খাস না। পাহারে চলে যা। মহুল ফুলের রস পাবি। কালো গরুর দুধ পাবি। পাহাড়ের বুকের ওম পাবি।’ পাহাড়কে জাগিয়ে তুলতে হয়। পাহাড় আমাকে নদীর কাছে যেতে বলেছিলপাহাড় আমাকে নাগরিক শহরে আসতে বলেছিল। আজ সকালে যেমন হল। একটু আগে হ্যাঁ আবার শুনতে পেলাম। ঘুঘুটা ডাকছে। এটা বলতে চাইনি। আজ সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। কারও বাড়িতে এফ এম রেডিওতে বাজছে মান্না দের গলায় সেই গানটা। ‘তুনি কি সেই আগের মতই আছ’? আচ্ছা পাহাড়ের লিঙ্গ কী? পাহাড় তুমি কি পুরুষ? তোমার তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব, দৃপ্ত পেশী, তবু তুমি নিশ্চল, নিশ্চুপ নীরবএমনতর ব্যক্তিত্ব বলেই কি তুমি পুরুষ? কিন্তু সযত্নলালিত তোমার বুকে তির তির করে বয়ে যাওয়া পিয়ানোর সুরের মতো ঝর্ণা, সরু নদী, কালো কালো গাছের পাতা, চিরসবুজ হলে তবেই না পাতার রঙে ওমন জলপাই গহন কালো সবুজ রঙ আসে। রঙ বহুরঙের প্রজাপতি, হলুদ পাখি, বৌ কথা কও, সাত ভাই চ্চম্পা সাত পাহাড়ের বুকের কাছে টেনে নিয়ে যায়। জোনাক জ্বলা সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। পাহাড়ি বুকের উষ্ণতা চুপি চুপি বলে আমি নারী। আজ আমি নদীর কাছে যাব না। আজ তির তির করে বরফ পড়ছে। আজ ঝির ঝির করে শিশির পড়ছে।  আমাকে পাহাড়ের কাছে থাকতে দাও। আমি পাহাড়ের পুরুষালী ঘ্রাণ পাচ্ছি। কিন্তু নদীও যে আমায় ডাকে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘’তীরে কি প্রচন্ড কলরব/ ‘জলে ভেসে যায় কার শব/ কোথা ছিলো বাড়ি?/ রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়- ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ (কবিতা, আমি স্বেচ্ছাচারী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়)                          

Monday, 24 December 2018

উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বর্গ এবং সাত পাহাড়ি বোনের দেশ



দীপেন্দু চৌধুরী
সময়ের হের ফের নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হল। কিন্তু অখন্ড ভারতের সাত বোনের আছে অখন্ড সময়। চুঁইয়ে পড়া বরফে ভেজা জংলা গাছের পাতায় আছে সাত বোনের হাতছানি। প্রকৃতি তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয়। রঙের প্রজাপতি ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয়। পাহাড়ি বাঁশির সুরে সাত বোনের আহ্বান শুনতে আমাদের হবেই। এমনটাই দাবি আলোকচিত্রশিল্পী এবং লেখক বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর।। সম্প্রতি কলকাতার অক্সফোর্ড বুকস্টোরে ‘’নর্থ ইষ্ট ইন্ডিয়া, বাইয়ো-রিসোর্স, পিপল এন্ড কালচার’’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ হল। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটা রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং হিমালয়  পাহাড়ের উপত্যকার রাজ্য সিকিম। এই সাতটা রাজ্যের জীববৈচিত্র, স্বতন্ত্র ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হেরিটেজ, জীবনযাত্রা, আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসব প্রভৃতি বিষয় রয়েছে ‘বি-বুকস’ থেকে প্রকাশিত  এই বইয়ে।
প্রকৃতির বৈচিত্রপূর্ণ পাহাড়ি সভ্যতার খোঁজে দু’বছর ধরে ছবি তুলেছেন বইটির আলোকচিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী। বইটি লিখেছেন দীনবন্ধু সাহু। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোনের দেশের গল্প অনেকটাই ছবিতে ধরতে চেয়েছেন যৌথভাবে লেখক দীনবন্ধু সাহু এবং বিশ্বজিৎবাবু। বইটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘-Book To Throw Light on the Bio-Diversity of the Seven Sisters’ এই বই আলোর খোঁজ দিতে চেয়েছে ভারতীয় পাঠকদের। এবং অবশ্যই আপামর বিশ্বের প্রকৃতি পিপাসু বই পড়ুয়াদের। আদিবাসী সমাজ সম্পর্কে আগ্রহী সংস্কৃতি পিপাসু মানুষকে। উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্য ব্যতিক্রমী উদাহারন হিসেবে ভারতের মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছে। যে অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এতটাই যে প্রকৃতি নিজের অভিভাবকত্বে পরিবেশ রক্ষা করে।
বইটি প্রকাশ করে বলছিলেন আমেরিকান কনসাল জেনারেল, কলকাতার প্যাট্টি হফম্যান। তিনি বইটি প্রকাশ করে গর্ব অনুভব করেন। তিনি বলেন, ‘’আমি মাস কয়েক হল দায়িত্ব নিয়েছি। উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটা রাজ্য সহ মোট ১১টা রাজ্য আমার দায়িত্বে রয়েছে। এই অঞ্চলের পোশাক, খাদ্য, সামাজিক এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র আমাকে মুগ্ধ করেছে। এতদ অঞ্চলের খাদ্য বৈচিত্রও এক অনন্য অভিঞ্জতা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে না মিশলে এই অভিঞ্জতা হবে না। আমি উত্তর পূর্ব ভারতের কয়েকটা রাজ্য ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছি। ওই সব অঞ্চলের জীব বৈচিত্র, সঙ্গীত, নৃত্যশৈলী, বন্যপ্রাণ আমাদের নতুনের আহ্বান জানায়। এই অঞ্চলেই সূর্য ওঠার ছবি নয়নভরে দেখতে হয়। সেই ছবি এই বইয়েও আছে।‘’
এদিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন আইএএস অফিসার রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব এবং প্রাবন্ধিক প্রসাদরঞ্জন রায়। তিনি বলেন, ‘’এশিয়ার বন্যপ্রাণ অথবা পশুপাখির অন্যতম অঞ্চল উত্তর পূর্ব ভারতের এই সাতটি রাজ্য। বইটা আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যে পড়েছি। রেফারেন্স বই হিসেবে খুব কাজে লাগবে। গবেষণার কাজেও বইটা কাজে আসবে। অনেক ভালো ভালো ছবি আছে। ছবির টানেই অনেকে এই বইটা পড়বেন আশা করা যায়।‘’
সঞ্চালক সোমেন সেনগুপ্ত জানতে চেয়েছিলেন এই বইয়ের ছবি তোলার সময় উত্তর পূর্ব ভারতের কোন বিষয়টা তাঁকে বেশি টেনেছে? উত্তরে আলোকচিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘’তিনটে বিষয়ের কথা আপনি উল্লেখ করলেন। বন্যপ্রাণ, আসামের কাজিরাঙ্গা পার্ক বা পশুপাখি এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমাকে টানে ল্যান্ডস্কেপ। অসাধারণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে আর কিছু টানে না।‘’
বিশ্বজিৎবাবু আরও বলেন, ‘’এই প্রকল্প আমরা দুবছর সময় নিয়ে করেছি। ৫৫০ পাতার বই। ছবি আছে প্রায় ৩০০ টি। বই প্রকাশের পর আমার মনে হয়েছে জীববৈচিত্রে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ভারতের প্রথম সারিতে আছে। নাগাল্যন্ডের অরণ্য মণিপুরের মত নয়। আমাদের এই কাজে সামজিক বৈচিত্র এসেছে। তাই চার্চের ছবিও আমি তুলেছি। তবে এই কাজ করে আমরা সন্তুষ্ট নই। পরে আরও গভীরে গিয়ে কিছু কিছু বিষয় সংযোজিত করার ইচ্ছে আছে।‘’
প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে বইয়ের লেখক দীনবন্ধু সাহু জানিয়েছেন, ‘’আমরা এক শৃঙ্গ গণ্ডারে ছবি যেমন বইয়ে ব্যবহার করেছি, আছে অর্কিডের ছবিও এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সম্পর্কে লেখা। উত্তর পূর্বের বাঁশের কাজ সম্পর্কেও আমরা তথ্য তুলে দিয়েছি। যেটাকে ক্র্যাফটসের কাজ বলা হয়ে থাকে। আমাদের আশা পাঠক এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় আগ্রহ খুঁজে পাবেন।‘’                       

Wednesday, 19 December 2018

সঙ্গীতের অভিযাত্রী দেবেন



দীপেন্দু চৌধুরী
অচেনার আনন্দ। অজানাকে জানার আনন্দ যারা খোঁজেন তাঁরাই শুধুমাত্র দেখতে পান এমনটা নয়। বংলা সাহিত্য এবং বিদেশী সাহিত্য আমাদের চিনিয়েছে অচেনার আনন্দ। অজানার আনন্দ। কিন্তু সঙ্গীত যখন আপামর মানুষকে টেনে নিয়ে যায় বিশ্বের দরবারে তখন সত্যি সত্যি আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। বিশ্বসঙ্গীতের দিকপালেরা রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, রবীশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, মোৎজার্ট, বেটোফেন এবং সত্যজিৎ রায়, বব ডিলান । এই সব নামের একই সরণীতে প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের আরও অনেক নাম এসে যায়। কিন্তু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া একটি নাম আমাদের সামনে এনে দিল কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজ। আরও বলা ভালো ফ্রেঞ্চ ন্যাশন্যাল লাইব্রেরী (বিএনএফ)। দেবেন ভট্টাচার্যের সৃষ্টির সংগ্রহ এখন থেকে পাওয়া যাবে বিএনএফ-এর সাউন্ড আর্কাইভে। বিংশ শতাব্দীর এক কালজয়ী সংগ্রহ ধরা আছে এই সংগ্রহে। এত বড় কাজটি করেছেন বিএনএফ-এর ডাইরেক্টর জিয়ান নওয়ল জিয়ান্নেনি(Jean Noe”l Jeanneney)।      
সঙ্গীতের জন্য তিনি সারা বিশ্ব ঘুরেছেন। সঙ্গীতকে আশ্রয় করে সমস্ত বিশ্বটা হয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের দেশ। পাশ্চাত্যকে জানার অদম্য কৌতূহল নিয়ে তিনি ১৯৪৯ সালের ৫ নভেম্বর লন্ডন পৌঁছন। ব্রিটেনে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন পোস্ট অফিসের চাকরি দিয়ে। কিন্তু তাঁর স্থান সেখানে নয়। তিনি খুঁজছেন ধ্রুপদী ঘরানার সঙ্গীত। তাই অস্থির মন, অস্থির চিত্ত নিয়ে তিনি খুঁজে চলেছেন বিশ্বের ধ্রুপদী সঙ্গীত, লোকগান। সন্ধান তিনি পেলেন। সুযোগ করে দিল বিবিসি রেডিও। বিবিসি সেই সময় একজন ভারতীয়কে খুঁজছেন যিনি তৎকালীন ভারতীয় সিনেমার গান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বিবিসি খুঁজছে সেই ব্যক্তিকে ভারতীয় সেই ব্যক্তি আরও জানবেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং ভারতীয় লোকসঙ্গীত। এই সমস্ত গুণ ছিল যে ব্যক্তির তাঁর নাম দেবেন ভট্টাচার্য। ১৯২১ সালে বারানসিতে জন্ম দেবেন ভট্টাচার্যের। পড়াশোনা করেছেন ‘টোল’-এ। জীবনের কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম দিকটা বারানসীতে দিন কেটেছে তাঁর। প্রথামাফিক শিক্ষা তাঁর হয়নি। তৎকালীন সময়ে তিনি পুরনো ভারতীয় পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। সেই সময়ের মত করে ধুতি পড়তেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে নতুন আলো দেখছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বিশ্বের দ্ধস্ত সমাজ। দেবেন সদ্য কর্ম জীবন শুরু করেছেন। প্রথম জীবনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কেরানীর চাকরি। বীমা সংস্থায় এজেন্ট এবং পার্ট টাইম সাংবাদিকের কাজ একসঙ্গে করেছেন। সময়টা বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি। এই সময়কালে তাঁর সঙ্গে দু’জন ইউরোপীয়ের দেখা হয় বারানসীতে। একজন রেমন্ড বার্ণার (Raymond Burnier) এবং দ্বিতীয়জন আলিয়ান দানিলু (Alian Danie’lou). রেমন্ডের আগ্রহ ছিল ভারতীয় শিল্প এবং স্কাল্পচার বিষয়ে। আর আলিয়ানের আগ্রহের বিষয় ছিল ভারতীয় সঙ্গীত। স্বশিক্ষিত দেবেন সংস্কৃত পড়েছিলেন ‘টোল’-এ কিন্তু পরের ইতিহাস আমাদের চমকে দেয়। কবি লিউইস টমসন তাঁর জীবনে একটা মস্তবড় বাঁক এনে দিয়েছিলেন।
ব্রিটেনে বিবিসি রেডিওর অভিঞ্জতা নিয়ে ১৯৫৪ সালে দেবেন ভট্টাচার্য স্বনামধন্য ইন্ডোলজিস্ট হয়ে দেশে ফেরেন। সংস্কৃত ‘টোল’-এ পড়া সেই দেবেন তখন পাশ্চাত্য সভ্যতায় স্নান করে ফিরেছেন আধুনিক মনন নিয়ে। কিছুদিন দেশে থেকে ফিরলেন লন্ডনে সঙ্গীতের অভিযাত্রী হয়ে। গ্রীস, ইতালি, তুর্কি, ইরাক, জর্ডন, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সঙ্গীতের উপর কাজ করলেন। এবং সেইসব সুর ‘আরগো রেকর্ড’ থেকে প্রকাশিত হয়। পরে ‘ইএমআই’ থেকেও রেকর্ড বের হয়। এই সময় দেবেন ভট্টাচার্যের ভাগ্য খুলে গেল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে সুইডেন সরকার প্রযোজনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন একটি ছবির জন্য। তাঁদের আর্থিক সহায়তায় দেবেনবাবু তৈরি করলেন ইউরোপীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার উপর সিনেমা। এই তথ্যচিত্র সুইডিশ সরকার দেশের শিশুদের সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষাশিবিরের জন্য প্রচারের কাজে ব্যবহার করে। পরে পরেই বিবিসি টেলিভিশন আগ্রহ প্রকাশ করে দক্ষিণ ভারতের ধ্রুপদী নৃত্য ‘কথাকলি’ এবং রাজস্থানের ‘কথক’দের (storytellers) বিষয়েদুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন তিনি। দর্শকদের থেকে ব্যপক প্রশংসা পায় ছবি দুটি         
তথ্য বলছে একটা সময় কমিউনিস্ট কবি স্টিফেন স্পেন্ডার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার জন্য লিখতে বলেছিলেন দেবেন ভট্টাচার্যকে। ‘এনকাউন্টার’ পত্রিকায় ভারতীয় কবিতা নিয়ে তাঁকে লিখতে বলেছিলেন স্টিফেন স্পেন্ডার। আরও জানা যাচ্ছে দেবেন ভট্টাচার্য ৪০০ ঘণ্টার সঙ্গীত বিষয়ক রেকর্ড তৈরি করে গেছেন। ১৫, ০০০ সাদাকালো এবং রঙ্গীন ছবি তুলেছেন। সেই ছবি শিল্পরসিকদের কাছে আজও মূল্যবান স্থীরচিত্র। ২২টি স্বল্প দৈর্ঘের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল বিষয়ক বই ‘দ্য মিরর অফ দ্য স্কাই’। দেবেনবাবুর কাজের ধারা দেখে সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যচিত্র পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক পেতে থাকেন। চিন, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের হয়ে তিনি ছবি তৈরি করেছেন।
বিবিসিতে কাজ করার সময় থেকেই তিনি পরিচয় লাভ করেন, একাধারে রেডিয়ো-প্রযোজক, রেকর্ড-প্রযোজক, লোকশিল্প-বিশেষঞ্জ, লেখক, কবি, অনুবাদক, চলচ্চিত্রকার। এক পাত্রে কত রত্নের সমাহার। তাঁকে যেমন অভিযাত্রী বলা যায় আবার শিল্প অভিযাত্রায় যেন ছিলেন পরিযায়ী পাখি। ইউরোপ এশিয়া ঘুরতে ঘুরতে প্যারিসে পেয়ে গেলেন পথ চলার জীবনসাথীকে। ১৯৬৯ সালে বিয়ে করলেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ঝর্না বসুকে। এবং প্যারিসে পাকাপাকিভাবে থেকে গেলেন। দেবেন ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি ছবি করেছেন স্তেফান জুরদ্যাঁ। ছবির নাম ‘মিউজিক অ্যাকর্ডিং টু দেবেন ভট্টাচার্য’। ১২ ডিসেম্বর কলকাতায় আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজে ছবিটি দেখানো হয়। এদিন তাঁর লেখা ‘প্যারিস টু ক্যালকাটাঃ মেন অ্যান্ড মিউজিক অন দ্যা ডেজার্ট রোড’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করেন বাংলাদেশ উপ দূতাবাস, কলকাতা-এর উপরাষ্ট্রদূত তৌফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘’আমার সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক পুরনো। আমার কর্মজীবনের প্রথম পোস্টিং ফ্রান্সে। দেবেন ভট্টাচার্য অবিভক্ত ভারতের মানুষ। ইউরোপ থেকে সঙ্গীত শিখে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বিঞ্জানী ছিলেন না। তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের সাম্রাজ্যে অনায়াসে বিচরণ করেছেন। আমরা গর্বিত দেবেন ভট্টাচার্যের জন্য।‘’
ইউনিসেফের মুখ্য ফিল্ড অফিসার মহম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘’আমি দেবেন ভট্টাচার্যের লেখা পড়েছি। আমার মনে হয়েছে কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর জীবনের মিল আছে। স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি। সঙ্গীতের জন্য লড়াই করেছেন। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে ভালো বেসেছিলেন।‘’
ঝর্না বসু বলেন, ‘’উনি যে বই লিখবেন আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। তাঁর সম্পর্কে আমি আর কি বলব? বিশ্বের যেসব গুণীজনের সঙ্গে তিনি জীবন কাটিয়েছেন তাঁরা তাঁর সম্পর্কে বলে গেছেন। ফরাসি সরকার তথা আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ, কলকাতার আধিকারিকদের ধন্যবাদ। তাঁরা বিস্মৃত এক ব্যক্তিকে বাঙালির গর্বের শহরে নতুন করে পৌঁছে দিলেন।‘’                        

Saturday, 15 December 2018

আরও এক ঐতিহ্যের সন্ধানে শ্রীঅরবিন্দের ভিটায়


দীপেন্দু চৌধুরী
গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের দাবিতে শহরের ছাত্র-ছাত্রী, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা পথে নেমছেন। ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা এবং ফ্রান্স কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা এই ধরণের নাগরিক আন্দোলনের পাশে থেকেছেন এবং থাকছেন। চন্দনগর একসময়ে ফ্রান্সের বাণিজ্যনগরী হিসেবে খাতি ছিল। সেই চন্দননগরের ফরাসি স্থাপত্যের সংরক্ষণের বিষয়ে ফরাসি কনস্যুলেট জেনারেলের কলকাতাস্থ অফিস ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।  কনস্যুলেট অফিস সূত্রে খবর, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় চন্দননগরের ফরাসি সভ্যতার স্মারক হিসেবে বাড়িগুলি অধিগ্রহণ এবং সৌন্দর্যায়নের কাজের সিদ্ধান্তও নিয়েছে কলকাতার ফরাসি কনসাল জেনারেল।
সম্প্রতি মধ্য কলকাতার বই পাড়ায় আরও একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ির খোঁজ পেলাম। আমার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে কলকাতায় একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ হয় শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের একজন আধিকারিকের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি কলেজ স্ট্রীটের ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বর্তমানে ভগ্নপ্রায় যে বাড়িটি আছে, সেই বাড়িতে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ আলিপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯০৯ সালের মে মাস থেকে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তাঁর মেসোমশায় কৃষ্ণকুমার মিত্রের এই বাড়িতে ছিলেন। আমি ১৫ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের দিলীপ কুমার চ্যাটার্জী সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলেন না। পরে আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে কয়েকটা চিঠির ফটোকপি দিয়ে বললেন, ‘’আপনি এই চিঠিগুলি থেকে আমাদের বক্তব্য পেয়ে যাবেন। আমি আলাদা করে কোনও কথা বলতে চাইছি না।‘’  
রাজ্য সরকারের হেরিটেজ বিষয়ক বিভিন্ন দফতরে পাঠানো শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের কয়েকটি চিঠির বিষয় থেকে জানা যাচ্ছে, কলেজ স্কোয়ারের পূর্বদিকে ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়ির ইতিহাসবাড়িটির স্মৃতি জড়িয়ে আছে উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ব্রাহ্মনেতা কৃষ্ণকুমার মিত্রের নামের সঙ্গে। এই বাড়িটি আদতে কৃষ্ণকুমার মিত্রের আদি বাসভবন কৃষ্ণকুমার মিত্র তৎকালীন বিখ্যাত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ইতিহাস বলছে এই ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। যে পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণকুমার স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম সারিতে চলে আসেন। যদিও কৃষ্ণকুমার নিজেও একজন স্বদেশী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে দীর্ঘদিন তাঁকে কারাবাস করতে হয়।
এই বাড়ির আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই ঐতিহাসিক বাড়িতেই এককালে বসবাস করেছেন বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ। তথ্য বলছে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে যে সমস্ত ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তাঁদের বিকল্প শিক্ষার জন্য ১৯০৬-এর অগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ সেই প্রতিষ্ঠানই আজকের বিশ্ববন্দিত বিশ্ববিদ্যালয়। যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রীঅরবিন্দ বরোদা থেকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন। এর পরের ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পরিচ্ছেদ। শ্রীঅরবিন্দ কলকাতায় এসেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের একটি গোষ্ঠীর প্রধান নেতার দায়িত্বে চলে আসেন। ১৯০৮ সালে শ্রীঅরবিন্দ ‘আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার’ অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার হলেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান। ওঠেন কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়ি ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িতে। এই বাড়িতে তিনি ছিলেন ১৯১০ সাল পর্যন্ত। যে তথ্য আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
 ‘ধর্ম’ এবং ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় ‘উদ্দেশ্যমূলক’ নিবন্ধ প্রকাশের অপরাধে ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শ্রীঅরবিন্দ গ্রেফতার এড়াতে বাগবাজার গঙ্গারঘাট থেকে চন্দননগর পৌঁছান এবং সেখান থেকে পন্ডিচেরি চলে যান। ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটি বর্তমানে অন্যের দখলে আছে। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ বড়িটি রাজ্য সরকারের অনুমতিক্রমে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। সেই সিদ্ধান্তমতো শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ ২০১২ সালের ২৯ অগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারমযান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যকে একটি চিঠি লেখে। সেই চিঠিতে শ্রীঅরবিন্দের ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির বিস্তারিত ইতিহাস এবং তথ্য উল্লেখ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে শ্রীপাঠমন্দির কতৃপক্ষকে উত্তর লেখেন। চিঠির রেফারেন্স নম্বর (570/P-181/WBHC/2012-13) রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারমযান কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ পরে একটি চিঠি লেখেন কলকাতা পুরসভার কমিশনার খলিল আহমেদকে। পুরকমিশনার সঙ্গে সঙ্গে চিঠিটি পুরসভার পি এম ইউ বিভাগের ডিজি  দেবাশিষ করের কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কলকাতা পুরসভাতে দৌড়ঝাপ করার পরে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ  কনভারশন কমিটির বৈঠকে (Memo No. MOA 27.4)নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির বিষয়ে চেয়ারম্যান খলিল আহমেদের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে বাড়িটির দলিল দস্তাবেজ দেখে বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ তালিকাভুক্ত করা হল। তিনমাস পরে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ বিধায়ক এবং রাজ্য সরকারের আবাসন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষ কলকাতা পুরসভার তৎকালীন মেয়র শোভন চ্যাটার্জীকে একটি চিঠি লেখেন। শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতি বিজড়িত ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির গ্রেড- ১ ঘোষণা করার অনুরোধ জানান তিনি
সম্প্রতি একটি সেমিনারে আমার সঙ্গে দেখা হয় বোম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমি বিষয়টা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে জানাই। এবং প্রশ্ন করি শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের কি করা উচিৎ। উত্তরে তিনি বলেন ‘’ওদের আর টি আই করে তথ্য বের করে আনতে বল। এবং প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে।‘’
বিধায়ক এবং আবাসন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষের চিঠির পরে প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও কলকাতা পুরসভা এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। সিদ্ধান্ত ঝুলেই রয়েছে। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির সূত্রে খবর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে মধ্য কলকাতার অন্যতম শিক্ষায়তন অধ্যুষিত বই পাড়ায় শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিতে শ্রীঅরবিন্দের নামে একটি গবেষণাহাব বা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ।                   
                  


Sunday, 9 December 2018

বন্যা হয় হোক আমাদের ‘নদী’ ফিরিয়ে দিন।





দীপেন্দু চৌধুরী
অরন্যের ‘আরন্যক’ পশুপাখি না মানুষ? গত কয়েক দশক ধরে বন্যপ্রাণী শিকারের মধ্যে এই প্রশ্ন এখন বার বার উঠছে। গভীর জঙ্গলে বন্যপ্রাণী কতটা নিরাপদ? চোরা শিকারী আর বন্য পশুর হাড়, মাংস মজ্জার চোরা ব্যবসায়ীদের সমঝোতায় জঙ্গলের নিরাপত্তা এখন আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে। তবুও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্য সরকার সচেষ্ট বাদাবন আর বন্যপ্রাণী রক্ষায়। ভারতবর্ষের মোট বাদাবনের এলাকা ৬, ৭৪০ বর্গ কি মি। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে এই বনভূমির বর্তমান আয়তন ৪, ২৬৩ বর্গ কি মি বা শতকরা ৬৩ ভাগ। সুন্দরবন বনাঞ্চলকে প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প অঞ্চল এবং ব্যাঘ্র প্রকল্প বহির্ভূত সুরক্ষিত বনাঞ্চল। এই অঞ্চলের বনভূমির এলাকা ৫৫ শতাংশ। এবং জলাভূমি ৪৫ শতাংশ, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প রয়েছে ২৫৮৫ বর্গ কি মি জুড়ে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকা বা সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান ১৩৩০ বর্গ কি মি। সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য ৩৬২ বর্গ কি মি। বাফার বনাঞ্চল বা সীমিত ব্যবহার যোগ্য বনাঞ্চল ৮৯৩ বর্গ কি মি।  
সুন্দরবন এলাকার প্রধান নদী কালিন্দী, রায়মঙ্গল, ঝিলা, গোসাবা, বিদ্যাধরি, মাতলা, ঠাকুরান প্রভৃতি। সুন্দরবনের বাদাবনে ও খাড়িতে রয়েছে অনেক অবলুপ্তপ্রায় প্রাণীর আবাসস্থল। যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নোনা জলের কুমির, ছোট গোসাপ, শুশুক প্রভৃতি। পরিবেশগত কারণে ইতিমধ্যেই শুশুকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বাঘের সংখ্যাও কম বলে সূত্রের খবর। বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসার কারণে গভীর জঙ্গলের বাঘ লোকালয়ে এসে পড়ছে। সুন্দরবন কলকাতা থেকে ১২০ কি মি দক্ষিণে।  
২০০৯ সালে ‘আয়লা’ নামক এক বিদ্ধংসী ঝড় সুন্দরবনের গঠনশৈলী অনেকটাই তোলপাড় করে দিয়েছে। যে লোকটার ক্ষেতে নোনাজল ঢুকছে সে কি করবে? সুন্দরবনের ১৫ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যত্র চলে গেছে। সুন্দরবন দিনের পর দিন কলকাতার দিকে এগিয়ে আসছে। শেষ পাঁচ দশকে ‘ঘোড়ামারা’ দ্বীপ অর্ধেকের বেশি জলের তলায় চলে গেছেবিষেষঞ্জরা বলছেন সুন্দরবনের অস্তিত্ব না থাকলে কলকাতার অস্তিত্ব থাকবে না। পরিসংখ্যান বলছে কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। বিশ্বে ৪০টি শহরের মধ্যে কলকাতায় গ্রীণ হাউস গ্যাস নিষ্কাশন সব থেকে বেশি। কলকাতায় প্রতি দশ জনের মধ্যে ৭ জন শ্বাসজনিত অসুখে ভোগেন। প্রতি তৃতীয় ব্যক্তি কলকাতার বস্তিতে থাকেন। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তি বস্তিতে থাকেন।
এই নিবন্ধ সুন্দরবন বিষয়ক কোনও রোমান্টিক বিষয় নয়। বিশ্বের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মানুষ আজও কতটা উদাসীন সেটা পরিসংখ্যাগুলির দিকে নজর দিলে বুঝতে পারব। পরিবেশ বিষয়ক জলবায়ু সম্মেলন ২০১৩ সালে প্যারিস শহরে হয়েছিল। প্যারিস সম্মেলনের ঘোষণা ছিল যৌথভাবে কাজ করতে হবে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য। প্যারিস প্রস্তাবে পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১) বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা। ২) তাপমাত্রার বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রিতে নামিয়ে আনাই পাখির চোখ ছিল। ৩) গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের মূল্যায়নে পাঁচ বছর অন্তর আলোচনা। ৪) ২০২০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ। ৫) ২০২৫ সালে ফের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা।
এই ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর ৪ ডিসেম্বর থেকে পোল্যান্ডের কাতোভিৎসায় শুরু হয়েছে জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন। ১৯৯৭ সালে জাপানে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য কিয়োটো প্রোটোকল অনুমোদন করা হয়েছিল। এই চুক্তির ভিত্তিতেই সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ চলছে। কিয়োটো চুক্তির খসড়া অনুযায়ী উন্নত দেশগুলিকে কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সাহায্য করতে হবে। কিয়োটো সম্মেলনে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। ভারত থেকে এই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। এই সম্মেলনে বাকী অন্যান্য বিষয়ে একমত হলেও সব দেশ কার্বন কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোখার ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্যের জন্য ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। বর্তমান সময়ের পরিসংখ্যান বলছে ভারতে গড়পড়তা ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয় তাপপ্রবাহের কারণে।  
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ১৩দিন ধরে আলোচনা করে ওই প্রতিনিধিরা ঠিক করে চূড়ান্ত খসড়া। সেই খসড়ায় আছে পৃথিবীর তাপমাত্রা যেন ২ ডিগ্রির বেশি না বাড়ে। এটা বিশ্বের মানবতাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ে নিয়ে যাওয়াটা হবে অন্যতম কাজ। অর্থাৎ উষ্ণায়নকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমায় বেঁধে রাখা। এই কথা মনে রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপযুক্ত অনুদান ও পাঁচ বছর অন্তর উষ্ণায়নের পরিস্থিতির পর্যালোচনার কথা উল্লেখ করা আছে প্যারিস চুক্তির খসড়ায়। প্যারিস চুক্তির খসড়ার গাইড লাইন মেনে এ বছর ৪ ডিসেম্বর থেকে কাতোভিৎসায় সম্মেলন হচ্ছে।
পরিবেশ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি
কাতোভিৎসার সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা করার আগে আমরা দেখে নেব ভারতের বিভিন্ন ভাষার সংবাদ মাধ্যম কতটা সচেতন পরিবেশ এবং বিশ্বের জলবায়ু প্রসঙ্গে? সম্প্রতি প্রসঙ্গটি আলোচনা হল পরিবেশ বিষয়ক একটি কর্মশালায়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে আলাদা আলাদা বিভিন্ন ‘বিট’ থাকলেও ‘পরিবেশ’ বিষয়ক আলাদা কোনও বিটের জন্য সাংবাদিকদের কতটা সুযোগ দেয়? পরিবেশ বিট বলে কোনও বিভাগ বা বিটের কথা আমাদের জানা নেই। বলছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক জয়ন্ত বসু। জয়ন্ত গত দশ বছর একটানা পরিবেশকে বিষয় করে সাংবাদিকতা করছেন। ২৮ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর কলকাতা প্রেসক্লাব, দ্য থার্ডপোল এবং কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল যৌথভাবে কলকাতার সাংবাদিকদের জন্য পরিবেশ বিষয়ক একটি কর্মশালার আয়োজন করে। ২৯ নভেম্বর ছিল সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ এবং আলোচনা। এই কর্মশালায় উঠে এল বিভিন্ন বিষয়। দূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ এবং আর্সেনিক ইত্যাদি বিষয় পরিবেশ নিয়ে ভারতে কাজ করছে ‘দ্যা থার্ডপোল’ নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জয়দীপ গুপ্ত বলেন, ‘’পরিবেশ বিষয়ক প্রত্যেকটি খবরই রাজনৈতিক খবর। অচিরাচরিত (সোলার এবং উইন্ড) বিদ্যুৎ সারা দেশের চাহিদার মাত্র ২৮% পূরণ  করে। ভারতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতার পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।‘’   
এই কর্মশালা সূত্রেই জানা গেল জার্মান কনসাল জেনারেল কলকাতার জন্য ২০১৭ সাল থেকে একটি প্রকল্প শুরু করেছে। প্রকল্পের নাম ‘’Greener, Cleaner World-Environment & Climate Change’’,  বর্তমান জার্মান কনসাল জেনারেল ডঃ মাইকেল ফেনার বলেন, ‘’ জার্মানি এবং ভারত দুটি দেশের সরকার যৌথভাবে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতার কাজ করতে চাইছে১৯, ০০০ বিঞ্জানী পরিবেশ রক্ষার কাজে এগিয়ে এসেছেন। এই দলে কয়েকজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিঞ্জানীও আছেন। জার্মানির মানুষ বায়ুদূষণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন। গত ২৫ বছরে ৭৫% প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমাদের দেশ। আমরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ‘ইকোলজি’ বিষয়ে সচেতন আছি।‘’
ডঃ ফেনারের বক্তব্যের সূত্র মাথায় রেখে বলতে হয় বিশ্ব নেতৃত্বের সবুজ বিনিময়ের হার আরও বাড়াতে হবে। ৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘কপ২৪’ শিরনামে এক সম্মেলন। পোল্যান্ডের কাতোভিৎসায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি অনুসারে আর্থিক সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরিদ্র দেশগুলির জন্য এই আর্থিক সহায়তা ভীষণভাবে প্রয়োজন। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যাচ্ছে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের তিন বছর পরে কাতোভিৎসার সম্মেলন হচ্ছে। বিশ্ব নেতৃত্ব তিনটে বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা করছে। তিনটে বিষয় হচ্ছে জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য আরও দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। প্রয়োজন জলবায়ু বিষয়ক সমস্যা সমাধানের আরও বিনিয়োগ। এবং প্যারিস চুক্তির নিয়মাবলী ঠিক করা এবং প্রয়োগ করাও অন্যতম কাজ। এই সূত্র থেকে আরও জানা যাচ্ছে আলোচনার মঞ্চ দখল করে রাখবে তিনটে বিষয় ১) ফান্ড ২) রুলস এবং ৩) গোল। ২৪ ডিসেম্বরের পরে আমরা জানতে পারব কি সিদ্ধান্ত হল রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রত্যক্ষ অভিভাবকত্বে ১০-১১ দিনের এই জলবায়ু বিষয়ক পর্যালোচনা সম্মেলনে।
মনে পড়ছে ভারতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক জয়ন্ত বসুর কথা। নভেম্বরের তিনদিনের কর্মশালায় নিজের অভিঞ্জতার কথা বলছিলেন তিনি। সিঙ্গুরে পরিবেশ দূষণ নিয়ে বামফ্রন্ট আমলে খবর করতে গিয়ে মার খেয়েছেন তিনি। একদল সমাজবিরোধী আক্রমণ করে তাঁদের। আবার উল্টো অভিঞ্জতার কথা বলেন তিনি। জয়ন্তের কথায়, কয়েক বছর আগে বন্যার পর তাঁরা উত্তর বঙ্গের কোনও একটি জেলায় পরিবেশ বিষয়ক খবর করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে শোনেন বন্যার কারণে একটি নদী গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ নদী  ফেরৎ চায়। জয়ন্ত বলেন, ‘’আমরা গ্রামের মানুষদের বললাম নদী থাকলে বন্যা হবে। আপনারা নদী চাইছেন কেন? গ্রামের মানুষ চিৎকার করে বলছেন আমাদের নদী ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নদী থাকলে আমাদের গ্রাম ছেড়ে বাইরে যেতে হবে না। নদী আমাদের জীবন। নদী আমাদের জীবিকা। নদী আমাদের মরণ। আমাদের নদী ফিরিয়ে দিন।‘’
ঠিক এই দাবিই উঠে এল কাতোভিৎসায়। গ্রেটা থুনবার্গ নামে ১৫ বছরের এক কিশোরী কাতোভিৎসায় গিয়ে বলছে, আমরা আমাদের রক্ষার জন্য বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে ভিক্ষে চাইছি না। আমরা তাঁদের জানাতে এসেছি ‘পরিবর্তন’ আসছে। গ্রেটা আরও বলেন, ‘’নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে থেকেই আমরা অপেক্ষা করব, কারণ বিশ্ব জলবায়ু রক্ষার নিয়ম সবাইকে মানতে হবে।‘’                     
 

Saturday, 1 December 2018

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা জঙ্গল বাঁচাতে গ্রামের মানুষকে ছবি আঁকতে বলতেন

দীপেন্দু চৌধুরী
অচেনা এক জংলি ফুলের ডাল। গাছ নয় ফুল এবং ডাল। যেটা একধরণের ফুল গাছের ছবি। লিফলেটে ছোট ছোট শব্দে রোমান হরফে  লেখা অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতের প্রকৃতি বিষয়ক এবং জন্তু-জানোয়ার, পাখির পেন্টিংয়ের প্রদর্শনী। দাবি করা হচ্ছে এটা একটা যৌথ প্রকল্পের শুরুয়াত।
কোম্পানী আমলের পেন্টিং বলে পরিচিত অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্বে আমাদের অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলার তিনজন বাঙালি শিল্পী এইসব ছবি এঁকেছিলেন। তিনজন চিত্রকর হচ্ছেন ভবানী দাস, রাম দাস এবং শেখ জাইন-আল-দিন (Shaikh Zayn – al - Din)উল্লেখিত তিনজন শিল্পী জলরঙে কিছু ছবি আঁকেন। অখন্ড ভারতের ব্রিটিশ যুগে আঁকা সেইসব ছবিকে চিত্র-সমালোচক এবং চিত্র-ঐতিহাসিকরা কোম্পানী আমলের ছবি বলে আখ্যায়িত করেছে। ভারতের জীবজন্তু বিষয়ক ২১০ খানা জলরঙে আঁকা ছবির সম্ভার এবং অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে আঁকা দেশীয় জীবজন্তুর ছবি (সংগৃহীত) প্রদর্শনীর জন্য সম্প্রতি একটি মৌ স্বাক্ষরিত হল কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়া হল এবং ব্রিটেনের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এই সমঝোতাপত্রে সই করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সচিব-কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত এবং ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্টিভ স্মিথ। আমাদের রাজ্যে ‘ভিক্টোরিয়া’ বলতে আমরা জানি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালা। অ্যালবার্ট হল, মানে এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নামে যে সংস্থা আছে। অর্থাৎ রয়্যাল অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (RAMM)
তৎকালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শল্য-চিকিৎসক এবং প্রকৃতিপ্রেমী সংগ্রাহক জন ফ্লেমিংয়ের হেফাজতে ছবিগুলি রাখা ছিল। সে সব ছবি এখন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহশালায় রয়েছে। পাশাপাশি এক্সিটারে অ্যালবার্ট স্মৃতি সংগ্রহশালায় রয়েছে রিচার্ড ক্রেসওয়েলের সংগ্রহ করা সমসাময়িক সময়ের প্রকৃতি বিষয়ক গাছপালার ছবি। ‘রয়াল অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (RAMM) সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই সময় কোম্পানীর কর্মরত আধিকারিকরা দেখেন গভীর জঙ্গল ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ গাছ এবং ফুলের নির্যাস দিয়ে জলরঙে ছবি আঁকছে। আবার কিছু মানুষ জঙ্গলের গাছ কেটে বাড়িতে শুকিয়ে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন শিল্পরসিক কোম্পানীর সাহেবরা জঙ্গল বাঁচাতে গ্রামের মানুষকে ছবি আঁকতে বলতেন। ব্রিটিশদের সেই সময়ের শ্লোগান ছিল, ‘প্রকৃতিকে হয় বাঁচিয়ে রাখতে হবে না হলে পেন্টিং রাখতে হবে।’
সমঝোতাপত্র সই হওয়ার পরে কিছু কাজ বাকী থাকে। সেই সব প্রশাসনিক কাজ শেষ হলে ২০২০ সাল নাগাদ শীতের দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটা নতুন ঘরানার ‘মিনিয়েচার’ প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাবে কলকাতা সহ রাজ্যের শিল্পরসিক মানুষ। এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের অধিকর্তা হলি মর্গেন রথ বলছিলেন, ‘’কোম্পানী আমল এবং ব্রিটিশ শাসনকাল সময়ে ভারতের রাজ-রাজাদের সংগ্রহে দেশীয় শিল্পীদের আঁকা অনেক ছবি ছিল। ছবিগুলি উন্নতমানের এবং ভীষণ গুরুত্ব রয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই জীববৈচিত্র বিষয়ক এবং শৈল্পিক বিষয়ে উন্নত মানের ছিল। সেই সব ছবি একুশ শতাব্দীতেও শিল্পবেত্তাদের কাছে সমান জনপ্রিয়।‘’
ওই বিশ্ববিদ্যলয়ের ইতিহাসের শিক্ষক নন্দিনী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘’শেখ যায়ান-আল-দিন ছিলেন মুঘল আমলের শিল্পী। আপনারা জানলে খুশি হবেন তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। তাই তাঁর পেন্টিংকে মুঘল আমলের পেন্টিং হিসেবে আমরা বিবেচনা করি।‘’
 স্লাইডে একটি ছবি দেখিয়ে নন্দিনী আরও বলেন, ‘’যেমন এই ছবিটা দেখছেন। এই ছবিতে পারসি ভাষায় লেখা রয়েছে। ‘নীল কন্ঠ পাখি পিপল গাছে’আমরা ছবির ঐতিহ্যের উপর কাজ করছি। আরও পরিকল্পনা আমাদের আছে।‘’
আমি জানতে চেয়েছিলাম ‘পটচিত্র’ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা? উত্তরে নন্দিনী বলেন, ‘’হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা বীরভূম, মুর্শিদাবাদের ‘পটচিত্র’ বিষয়ে গবেষণা কিছুদিনের মধ্যে শুরু করব। এই মাধ্যমেও ভালো ছবি পাওয়া যাবে। পটচিত্রের ইতিহাসও মুঘল যুগের।‘’
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক অ্যান্ড্রু রাডরা বলছিলেন, তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম ছিল, ব্লু প্ল্যান্ট- II , ‘’বন জঙ্গলে হিংস্র পশুরাজ অনেকটা মানব শিশুর মতো যদি আমরা আমাদের অনুভব দিয়ে দেখি।‘’ তিনি স্লাইডে দেখান ডঃ উইলিয়াম রক্সবার্গ (১৭৫১-১৮৫১) এর ছবি। ১৭৮৭ সালের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ছবি আমরা দেখলাম স্লাইডের পর্দায়।
এক্সিটারের ভাইস- চ্যান্সেলর স্টিভ স্মিথ শুরুতেই বলেন, ‘’ব্রিটেন বর্তমান সময়ে নতুন বন্ধু খুঁজছে। ইউরোপের বাইরে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে এর উজ্জ্বল স্মভাবনা রয়েছে।‘’
জয়ন্তবাবু বলেন, ‘’এই যৌথ উদ্যোগ আমাদের নতুন পথ চিনতে সাহায্য করবে। পেন্টিংয়ের ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছি। বিদেশের প্রথমসারির কোনও বিশ্ব বিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা এই ধরণের কাজ আগে করিনি।‘’
সংযোজনঃ এই লেখাটি ২ ডিসেম্বর, ২০১৮ রবিবারের বাংলা জনপ্রিয় দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকার রবিবাসরের তৃতীয় পাতায় প্রকাশ হয়েছে। আজ আমি গর্ব অনুভব করছি। সাংবাদিকতার মূল ধারায় ১৯৮৪ সালে যোগ দেওয়ার কথা ছিল আজকাল পত্রিকায়। ১৯৮৪ সালে সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাকে তৎকালীন সম্পাদক পূষণ গুপ্তের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূষণবাবুর সঙ্গে পাকা কথাও হয়ে যায়। আমি আজকাল পত্রিকার বিনোদনের পাতায় জয়েন করব। কিন্তু না কোনও এক অদৃশ্য কারণে আমার চাকরিটা হল না। তারপর ৩৪ বছর পর কত চেনা পথ, অচেনা ফুটপাথ টপকে আজ সেই আশির দশকের স্বপ্নের কাগজের হাত ধরলাম। যারা পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁদের শুভেছা জানাই।